বৃত্তরৈখিক - পর্ব ২ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২২ আগস্ট ২০২০ | ৩১৬৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
ছেলেটার কিছুই করার নেই তখন, কিছু করার ইচ্ছেও নেই বোধ হয়। টিলা থেকে নেমে একটু হাঁটা-চলা করে আবার এসে বসলো ঐ টিলার ওপরেই। ঝোলা গোছের কিছু একটা সঙ্গে ছিলো তার, সেটা থেকে বের করলো মিইয়ে যাওয়া একটা মুড়ির মোড়ক, সেটা খুলে মুড়িটা খেয়ে খানিকটা হেঁটে একটা ঝর্ণার জল খেয়ে নিলো পেট ভরে, তারপর আবার ঐ টিলার ওপরেই ফিরে এসে শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন, ওপরের নীল আকাশটায় লেগেছে সূর্যাস্তের রঙের ছোঁয়া, ভাসমান এক-একটা সাদা মেঘ এসে সেই নীল ক্যানভাসে লাল-কমলা রঙের ওপর ছোট ছোট প্যাটার্ণ তৈরি করছে; সেই অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন বুজে এলো তার ক্লান্ত চোখ দুটো, না জেনেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
বৃত্তরৈখিক ৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৮৬৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেলো, এক দুপুরবেলা। বাইরের ঘরে বসে ছিলো তুলিকা আর জয়ি, দুজনে মিলে প্ল্যান করছিলো কেমন হবে পরের সংখ্যা শাম্বর প্রচ্ছদ। তুলির সামনে একটা বড় সাদা কাগজ, হাতে পেনসিল, একটা দুটো আঁচড় পড়েছে কাগজটায়, আর গলা ছেড়ে গাইছে জয়ি, মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে, এমন সময় বাইরের থেকে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কার শব্দ, আর তার সাথে উচ্চকিত কণ্ঠ: কে গায় আমার গান, আমার গান গাইছে কে! থেমে যায় জয়ি, একটু ঘাবড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসু চোখমুখে তাকায় তুলির দিকে। ঠোঁট উলটিয়ে, বিস্ফারিত চোখে, দুটো হাতের কব্জি ঘুরিয়ে বোঝায় তুলি সে-ও বুঝছে না কিছু। এমন সময় আবার দরজায় ধাক্কা: কে গাইছে আমার গান?
বৃত্তরৈখিক (৫) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৬৫৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
পবিত্র পরিচয় করিয়ে দিলো, এই আমিনুলদা, বিপ্লবের ভার বহন করতে করতে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার যোগাড়; আর উজ্জয়িনী, উজ্জয়িনী ভৌমিক, এত বড় নামটা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে, সাবজেক্টিভ আর অবজেক্টিভ কণ্ডিশন মিলে গেলেই ওজনদার নামটা ত্যাগ করে বিপ্লবকে নিয়ে নেবে মাথায়। আমিনুলদা, আমাদের নতুন কমরেড সোমেশ্বর, সোম বলে ডাকতে পারো, ফাটাফাটি কবিতা লেখে। লাল-টালের ছিটে আছে, রক্তপাতও ঘটাচ্ছে একটু একটু, আর এই ওর বন্ধু স্বরাজ। একে একে বিভিন্ন কলেজের কিছু কিছু ছেলেমেয়ে আসতে শুরু করলো, আড্ডা শুরু হলো, একটু-আধটু কবিতা, গান, আর তার পরেই জোর তর্ক। এ তর্কে যোগ দিতে পারলো না সোমেশ্বর, বিষয়টা প্রায় অজানাই ওর। তেনালী নামের কোন একটা জায়গায় কম্যুনিস্ট পার্টির লোকজনরা কিছু একটা মীটিং করেছে, সেই মীটিং নিয়েই তর্ক।
বৃত্তরৈখিক (৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৮০১ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
শুধুমাত্র ছবি আঁকার জোরে টাকা-পয়সা আয় করে কলকাতায় কাটিয়ে এসেছে জয়ি কয়েক মাস, শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেককেই চেনে সে এখন, জয়ি এখন স্বাভাবিক নেতা ওর বন্ধু-বান্ধবীদের। সবাই মিলে ঠিক হয়েছে পরের সংখ্যা থেকে শাম্ব ছাপানো হবে, আর হাতে-লেখা নয়। রাঁচি থেকে শ্যামলিমা-অরুণিমাও এলো; দুজন সম্পাদক, অরুণিমা আর জয়ি। তুলি প্রস্তাব দিয়েছিলো শাম্বর ঠিকানাটাও বদলিয়ে এখন কলকাতায় জেঠুর বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হোক, সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলো। জয়ি বললো কলকাতার হাজারো লিট্ল্ ম্যাগাজিনের মধ্যে শাম্ব হারিয়ে যাবে, এখানকার ঠিকানাই ভালো।
বৃত্তরৈখিক (৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ২৭৫০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
হাওড়ায় এক নতুন জগতের মধ্যে এসে পড়লো যদুগোপাল। এতদিন পর্যন্ত সারিখোল গ্রাম আর নবদ্বীপের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিলো না তার, এই তার প্রথম নাগরিক জীবন। শশধর বেদান্তবাগীশের বাড়িটি পাকা, চওড়া রাস্তার উপর ত্রিতল ইমারত। বাড়ির নীচের তলার সামনের অংশে, একেবারে রাস্তার উপর তাঁর দু কামরার চতুষ্পাঠী বা টোল। সাইনবোর্ডে লেখা শশধর শাস্ত্রীয় সংস্কৃত শিক্ষালয়। ঘর দুটোয় দুটো করে দরজা, কোনাকুনি। একটার সামনে দাঁড়ালে অন্যটা পেরিয়ে চোখ যায় না। একটা রাস্তার সঙ্গে সংযোগ করে, অন্যটা অন্দরের সঙ্গে। সেই দরজা পেরিয়ে অন্দরে ঢুকলে দেখা যাবে আরও তিনটে ঘর, সামনে টানা বারান্দা। বারান্দার সামনে উঠোন, পেরিয়ে রান্নাঘর। এই ঘর তিনটের একটা ব্যবহার করা হয় টোলের আবাসিক ছাত্রদের বাসস্থান হিসেবে, টানা চৌকিতে যেখানে শুতে পারে পাঁচ-ছ জন ছাত্র। বাকি ঘর দুটোর মধ্যে একটার ব্যবহার ভাঁড়ার ঘর হিসেবে, যে ভাঁড়ার উল্টো দিকের রান্নাঘরে ব্যবহৃত হয়।
বৃত্তরৈখিক (৮) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১০ অক্টোবর ২০২০ | ২৬১৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
দরবেশ শাহ্ হেমন্তকে দেখে খুব খুশি, ওর ধারণা ছিলো হেমন্ত বুঝি স্টীল প্লান্টেই চাকরি করছে, সেরকমই তো কথা ছিলো, তাই বুঝি যোগাযোগ রাখার সময় পায় না। জয়মালিকাকে দেখে অবাক ও, হেমন্তর মেয়ে এত বড়! তারপর অবিশ্যি হিসেব-টিসেব করে বললো, না এমনই তো হবার কথা! ও যে নিজেই বুড়ো হয়ে গেছে সেকথা ওকে মনে করিয়ে দেবার কেউ নেই, তাই ওর সব কিছু গুলিয়ে যায় এখন! কী প্রয়োজনে এসেছে জয়মালিকার কাছে শুনে ও পিঠ চাপড়ে দিলো জয়মালিকার। এ-হি তো চাই, খুব স্মার্ট তোমার মেয়ে হেমন্ত, কোথায় কোথায় সুযোগ আছে দু চোখ মেলে দেখতে জানে! এমনটা যদি তুমি হতে আমার পুরো কারবারটা আজ তোমারই হতো!
বৃত্তরৈখিক (৯) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ১৮১৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
কেন, কী ভাবে ওখানে থাকে, ওর চাকরি এখানে কোন্ সূত্রে হলো, সবটা শুনে হালদার বাবু বললেন, তাহলে তো প্রথমেই আপনার শিফ্ট্ করা দরকার। ওখানে থাকবেন কেন? এখন তো আপনার এনটাইট্ল্মেন্ট ডী-ওয়ানে। দাঁড়ান, আমি দেখছি, বলে একটা ফাইল নিয়ে আসেন হালদার বাবু। উল্টে-পাল্টে বললেন, তিনটে কোয়ার্টার খালি আছে ডী-ওয়ানে, তেইশ নম্বর, একচল্লিশ আর আটাত্তর। আজ যাবার আগে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে যাবেন তিনটে কোয়ার্টারের, দেখে নিন তিনটেই, বলে দেবেন কোন্টা পছন্দ। রিপেয়ার-পেন্টিং সব করিয়ে দেব তিন-চার দিনের মধ্যে। এই সপ্তাহেই শিফ্ট্ করে নিন, আমি কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলে রাখবো, গাড়ি-টাড়ি নিয়ে চলে যাবে, ওর লোকজনরাই সব গুছিয়ে গাছিয়ে দিয়ে আসবে।
বৃত্তরৈখিক (১০) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৪ অক্টোবর ২০২০ | ২৪৮৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
স্কুলে যেতে শুরু করলো সতীনাথ, মহা উৎসাহে। বাবার টোলের মতো আসন পেতে বসতে হয় না সেখানে, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি-ডেস্কের ব্যবস্থা। স্যররা চকখড়ি দিয়ে দেয়ালে টাঙানো ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে লিখে পড়ান, সমস্ত ক্লাসের ছেলে একসাথে দেখতে পায় সে লেখা। টিফিনের ছুটিতে দৌড়োদৌড়ি-খেলাধুলো হয়, খুবই মজা। অনেক কিছু নতুন নতুন শিখেছে সে, কিন্তু বাড়িতে শেখাবার কাউকে পাওয়া যায় না। বড়দিকে পড়তে বললেই রান্নাঘরে মায়ের কাছে পালিয়ে যায়, ছোড়দির সাথে খুব ভাব তার, ভাইকে খুশি করার জন্যে খাতা পেনসিল নিয়ে পড়তে বসেও সে, কিন্তু কী বোকা ! এতদিনেও ঠিক ঠিক মতো এ-বি-সি-ডি শিখতেও পারলো না। দশ বার দিন পর পর ফুলকাকা আসে খড়গপুর থেকে, তাকেই সতীনাথ পড়ায়, সে শিখেও যায় চটপট।
বৃত্তরৈখিক (১১) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ২৩৪৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
সতীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি কলেজে ফিলসফি পড়তুম। প্রথম যখন হেগেল-মার্কস পড়েছি, আমরাও মনে মনে মার্কসকে শ্রদ্ধা করেছি; তোর এখন যে বয়েস, এ বয়েসে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলুম, মার্কসিস্ট হওয়ার কথা ভাবিওনি। কেন জানিস? নৈতিক সংঘাত। আমাদের আজন্ম শিক্ষা নাস্তিক মার্কসের মেটিরিয়ালিজ্ম্ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। তোদের তো আমি সেভাবে মানুষ করতে পারিনি। এই তো, এখনই সন্ধ্যা-আহ্ণিক বন্ধ করে দিয়েছিস, বাইরে কার হাতে কী খেয়ে বেড়াস আমি ভয়ে জিজ্ঞাসাই করি না। আমি এখনো বেঁচে আছি, তা সত্ত্বেও পৈতেটা পর্যন্ত ফেলে দিয়েছিস তুই, যদুগোপাল ন্যায়রত্নের পৌত্র !
বৃত্তরৈখিক (১৩) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৭০৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
জায়গাটার কথা ভাসা ভাসাই বলেছিলেন গণেশদা, কম কথা বলেন; খোঁজ কোরে কোরে জয়ি পৌঁছিয়ে গেলো একদিন জি-সি-লাহার দোকানের উল্টোদিকে ন্যূয়র্ক সোডা ফাউন্টেন রেস্টোর্যান্টে। এখানে ওখানে নানা টেবিলে ছড়িয়ে বসে আছে অনেক চেনা মুখ। দাড়িওয়ালা যে ভদ্রলোক এগজিবিশনে ওর ছবিটাকে বাঁধিয়ে আনতে বলেছিলেন দেখা গেলো তিনি বসে আছেন গণেশদার সাথে। জয়ির অভ্যেস আছে বিনা আহ্বানে বসার, কফি হাউজে এরকম বসেছে বিস্তর, বসে গেলো।
বৃত্তরৈখিক (১৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ২২৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে সোমেশ্বর। সব হিসেবেরই কী গণ্ডগোল হয়ে গেলো? উনসত্তর সালে চারু মজুমদার নতুন পার্টির নাম ঘোষণা করলেন, সি-পি-আই (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। কিন্তু পার্টি তৈরি হবার আগেই তো পার্টি ভেঙে গেছে ! আগের পাঁচ বছর ধরে ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে গেঁথে যে মন্দির তৈরি করছিলেন চারু মজুমদার, সে মন্দিরে মাথা নীচু করে ঢুকতে চাইলো না যারা, যারা মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান বলে প্রণাম করতে রাজি হলো না, পিকিং রেডিও ঘোষিত রোজনামচার সাথে যারা নিজেদের রোজনামচাকে মেলাতে পারলো না, একেকটি 'খতম' থেকে আশ্চর্য অলৌকিক উপায়ে একেকটি মুক্তাঞ্চল গঠনের ম্যাজিকে যারা বিশ্বাস করতে পারলো না, কমরেড চারু মজুমদারের লাইনই একমাত্র সরলরেখা, এই মন্ত্রকে যাদের মনে হলো আজগুবি, তারা তো আগেই শ্রেণীশত্রু ঘোষিত হয়ে গেছে ! তারপর তো রাস্তাঘাটে-অলিতে গলিতে শুধুই মৃত্যুর মিছিল !
বৃত্তরৈখিক (১৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ জানুয়ারি ২০২১ | ১৩১৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
রেস্ট হাউজের বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে দিয়ে চৌকিদার গেলো সাহেবকে খুঁজতে। বিক্রম বললেন, কনের বাড়িতে আপনি থাকতে চাইবেন তা আমি জানি। কিন্তু সত্যি-সত্যিই থাকা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আপনি আমার নামটা যদি খেয়াল করে থাকেন তা হলে বুঝতে পারবেন আমি ঠিক আপনাদের মতো ভদ্দরলোক সমাজের মানুষ নই, আমিও, যাকে আপনারা বলেন ট্রাইবাল, মুণ্ডা। তবে মুণ্ডা আর সাঁওতালরা সংখ্যায় বেশি, অনেক আগেই ক্রিশ্চান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসেছে, অনেকেই লেখাপড়া শিখেছে ওদেরই দয়ায় – ইনক্লুডিং মী। কিন্তু খাড়িয়ারা সংখ্যায় অনেক কম। ওদের মধ্যে আবার তিন রকমের ভাগ আছে। যাদের বলে দুধ-খাড়িয়া আর ধেলকি-খাড়িয়া তারা জঙ্গল ছেড়েছে আগেই, এখন চাষবাস করে, সাঁওতাল-মুণ্ডাদের থেকে ওদের চট করে আলাদা করতে পারবেন না।
বৃত্তরৈখিক (১৯) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৩ জানুয়ারি ২০২১ | ২৫৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
জে জে স্কুলের পাঠ শেষ হলে আমার বাবা – নিশ্চয়ই বুঝেছো উমেশ আমার বাবার নাম – বোম্বে ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকে গেলো আর ভূতনাথ চৌধুরি তাঁর মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন য়্যোরোপে। কোন বিশেষ আর্ট স্কুলে নয় কিন্তু, তাঁর অনেক বন্ধু ছিলেন য়্যোরোপে, তাদের তত্ত্বাবধানে পুরো কন্টিনেন্ট ঘুরে গ্রেট মাস্টার্সদের ছবি দেখা আর নানা সেমিনারে যোগ দেওয়া দু বছর ধরে; এটাই কাজ, এটাই হায়ার এডুকেশন। দু বছর পর যখন ফিরলো রুনু পিসি, তার মধ্যে আমাদের বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী বাবার বিয়ে হয়ে গেছে, আরও বছর খানেক পর জন্মালাম আমি। আমার দখল নিয়ে নিলো রুনু পিসি।
বৃত্তরৈখিক (১৮) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ২০৬৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
শুধু যে ছবি কেউ কেনেনি তা-ই তো নয় ! এতগুলো খবরের কাগজ আর পত্রিকায় নিজে গিয়ে সম্পাদক আর যাদের যাদের চিনতো, উদ্বোধনের দিনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন কোরে এসেছিলো তাদের। কোনও কাগজে, কোনও পত্রিকায়, কেউ একটা মন্তব্যও করলো না ! এ ছাড়াও কলকাতায় ওর চেনা-জানা লোক তো কম নেই। শিল্পসাহিত্য মহলে যারা ঘোরাঘুরি করে, যাদের মধ্যে অনেকেই কিছু-না-কিছু লিখেছে-এঁকেছে শাম্বর জন্যে, তাদেরও তো অনুরোধ করেছিলো আসার জন্যে, কতজনই বা এলো ! এমনকি এসেওছিলো যারা, ওর ছবির বিষয়ে ভালোমন্দ মন্তব্যই বা করলো তাদের মধ্যে কতো জন ! জঙ্গল নিয়ে, জঙ্গলে ওর যাওয়া-থাকা-সময় কাটানো, এ সব নিয়েও উৎসাহ দেখালো অনেকে, কিন্তু ছবির বিষয়ে খুব একটা গুরুত্বই কেউ দিলো বলে মনে হলো না।
বৃত্তরৈখিক (২০) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ২৬৯৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
মিষ্টি হাসে জয়মালিকা। সামনের গ্লাসটার কমলা রঙের সফ্ট্ ড্রিঙ্কটায় ছোট একটা চুমুক দিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক য়্যু। একটা কথা একটু বিশদে বলে দিই। কুরুখ আমাদের ভাষার নাম, ঐ ভাষার সুবাদেই আমাদের অঞ্চলের লোকরা আমাদের কুরুখ বলে পরিচয় দেয়। আসলে যে উপজাতির মানুষ আমরা, তার নাম হলো ওরাওঁ। এ নামটা অনেক বেশি পরিচিত, আপনারা অনেকেই শুনেছেন নিশ্চয়ই। আর, সৌন্দর্যের যে কথা ম্যাডাম বললেন, সেটার সম্বন্ধে শুধু এইটুকুই বলবো, আমি আমাদের অঞ্চলের সেরা সুন্দরী নই, এমনকি, সেরাদের মধ্যে একজনও নই। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের গণমাধ্যমে তথাকথিত ট্রাইবালদের যে অতি পরিচিত মুখটা দেখানো হয়, সেটা কোন্ ট্রাইবের কেউ জানে না। ট্রাইবাল-মেনস্ট্রীম ডিভাইডের ট্রাইবাল ফেস ওটা।
বৃত্তরৈখিক (২১) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৫৪৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এটা আসলে একটা লাক্ষার কারখানা ছিলো, বললো হেমন্ত। কারখানা মানে এমন কিছু নয়, সোজা জঙ্গল থেকে নিয়ে এসে এখানে জমা করতো লোকজন, তারপর রোদ্দুরে দেওয়া, ধোয়া, শুকোনো টুকোনো, এই সব। এক্সপোর্ট হতো, লাভও হতো ভালোই। কম্পানির মালিক মারোয়াড়ি, সে লোকও ভালো। আমার সাথে যখন আলাপ হলো তখন মনে হলো ও বেঁচে গেছে। পুরুলিয়া শহরে আর কলকাতায় ওদের নানা রকমের ব্যাবসা আছে, এখানকার ব্যাবসায় সময় দিতে পারছিলো না। সে দায়িত্বটা নিলাম আমি। কিন্তু শুধু সেটাই নয়, কারখানা দেখাশোনার জন্যে আমার মতো লোক ও হয়তো আরও পেতে পারতো। ওর সমস্যা ছিলো অন্য জায়গায়। এই যে কম্পাউণ্ডটা, প্রায় বিঘে চল্লিশ জমি, এই জমিটা ওর নিজের নয়। এটা ট্রাইবাল ল্যাণ্ড। আইন অনুযায়ী এই জমিটা ও নিতে পারছিলো না। লোকটা আমাকে খুবই বিশ্বাস করে। ওকে আমি যখন আমার শিডিউল্ড্ ট্রাইব স্টেটাসের কথা বললাম, ও যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলো। জমিটা ও কিনে নিলো আমার নামে।
বৃত্তরৈখিক (২২) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৭৩৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
সুদেশের বাড়ি সারপেন্টাইন লেনে। মিনিট তিনেক হেঁটেই ওরা পৌঁছিয়ে যায়। ঠিক এরকম বাড়ি কখনও দেখেনি জয়ি। ছোট দরজাটা প্রায় রাস্তার ওপর। সেটা দিয়ে ঢুকলে সামনেই একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা সিমেন্টের, যথেষ্ট অপরিসর, এবং পুরোপুরি শুকনো নয়। সিঁড়িটার আংশিক ভিজে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগে না। সিঁড়ির পাশেই একটা খোলা জায়গা, জায়গাটা ভিজে, এবং সেখানে দু-তিনটে লোহার বালতি। খোলা জায়গাটার শেষে প্লাস্টার-খসা যে দেয়ালটা ওপরে উঠে গেছে, রং-চটে যাওয়া সেই দেয়ালের নীচের অংশে খানিকটা ক্ষয়ে যাওয়া একটা দরজা। বোঝা যায় ওটার ভেতরটায় স্নান করার জায়গা, যেখানে কোন জানলা আছে বলে অন্তত বাইরের থেকে বোঝা যায় না। খোলা জায়গাটা ভেজা কেন, এবং কেনই বা ওখানে বালতিগুলো, সেটা বোঝা যায় এবার।
বৃত্তরৈখিক (২৩) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ২৩৭৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
এতো সমৃদ্ধ এবং এতো প্রাচীন ভাষার নিজস্ব কোন লিপি নেই। সংস্কৃতের কন্যা নয়, অতএব উত্তরভারতীয় ভাষাগুলোর মতো দেবনাগরী-সম্ভূত লিপি গড়ে ওঠেনি সাঁওতালি ভাষার জন্যে। লিপিহীন এই কথ্য ভাষা তাই হোঁচট খেতে খেতেই চলতে বাধ্য হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে। এই অবস্থার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালাচ্ছেন ভাষাবিদ এক শিক্ষিত লড়াকু সাঁওতাল, তাঁর নাম রঘুনাথ মুর্মু। শুধু লিপি তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, ছাপাখানার কাজ শিখে, একটা একটা করে তৈরি করেছেন সাঁওতালি অক্ষর – জন্ম নিয়েছে অলচিকি লিপিমালা। তাঁর একনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে জলধর একজন, সে সাঁওতালি এবং বাংলা, দুটি ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ, দুটি ভাষাতেই কবিতা লেখে। রঘুনাথ নামে একটি মাসিক পত্রিকা চালায় সে, পত্রিকাটি দ্বিভাষিক – সাঁওতালি আর বাংলা – সে-ই সম্পাদক এবং প্রকাশক। এই পত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখে নিলীন এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকর্মী কয়েকজন।
বৃত্তরৈখিক (২৫) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৩ মার্চ ২০২১ | ২৬৬২ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
নিলীন অকপটেই স্বীকার করে ছবির এগজিবিশন অর্গানাইজ করার ব্যাপারে কোনই ধারণা নেই ওর, কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে হবে না কেন? বান্দোয়ানে ওর বন্ধু আছে জলধর, সাঁওতাল সমাজে তার খুব প্রতিষ্ঠা, তার সাহায্য নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তা ছাড়া সুদেশ আর জয়ি মিলে কলকাতায় একটা এগজিবিশন তো করেছিলো আগেই। আর বোম্বেতে মহেশের সাথেও ছিলো, সেগুলোর থেকেও তো নিশ্চয়ই খানিকটা শিখেছে ওরা।
খুশিঝোরাতে এগজিবিশন করার কথা জয়ির মাথায় আসেনি আগে, কিন্তু এখন সে রীতিমতো উত্তেজিত। শুভেন্দুদাকে জিজ্ঞেস করে, খুশিঝোরাতে যদি করি এগজিবিশন, যাবেন আপনি?
বৃত্তরৈখিক (২৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২০ মার্চ ২০২১ | ১৭৩৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আজ পাঁচ তারিখ রোববার, সতেরো তারিখ শুক্রবার সে, জয়ি আর জুঁই পৌঁছোবে খুশিঝোরা – সুকান্তর যাওয়ার কথাটাও বললো সে, অ্যাজ আ গেস্ট – উনিশ তারিখ রোববারের মধ্যে সবাই যেন আসে। খুশিঝোরা সমিতির প্রথম ফর্মাল মীটিঙে। তুলি শুনে বললো আমি তো যেতে পারবো না এ কদিনের মধ্যে, তোরা সবাই মিলে যা ঠিক করবি, সেটাই হবে, আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই। অরুণিমা শ্যামলিমা সুজয়, তিনজনেই বললো আসবে। খবর দেওয়া গেলো না নিলীনকে, যে টেলিফোনে ওর সাথে যোগাযোগ রাখে জয়ি, সেটা য়্যুনিভার্সিটিতে ওর ডিপার্টমেন্টের টেলিফোন, কাজেই কালকের আগে যোগাযোগ করা যাবে না ওর সাথে। এ দায়িত্বটা নিলো জয়ি, আর তার সাথে বাবার মারফত জলধরকেও খবর দেওয়া।
বৃত্তরৈখিক (২৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৭ মার্চ ২০২১ | ২৩৫৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
স্থানীয় লোকদের মধ্যেও খুব প্রভাব পড়লো এগজিবিশনটার। প্রথম কয়েকদিন এখানকার মানুষরা অবাক হয়ে এতো বাইরের লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে সাহস করেনি। কিন্তু জলধর আর হেমন্ত সে সঙ্কোচ ভেঙে দিলো। কয়েকটা বাচ্চাকে ছবি দেখাতে নিয়ে এলো জলধর। তারা এতো ছবি এক জায়গায় দেখে অবাক। ধীরে ধীরে আসতে শুরু করলো তাদের বাড়ির লোকরা, বাবা-মা, ভাইবোন, সবাই। হেমন্তর উদ্যোগে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের একটা 'বসে আঁকো' প্রতিযোগিতাও হয়ে গেলো, এবং প্রতিযোগিতার ছবিগুলোর থেকে গোটা দশেক ছবি প্রদর্শনী কক্ষেও লাগিয়ে দেওয়া হলো। জয়ি বুঝলো শুভেন্দুদা কেন আদিবাসীদের মধ্যে এই ছবির প্রদর্শনী করতে বলেছিলেন।
বৃত্তরৈখিক (২৮) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ২৩২৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
তোমার প্রতিভা ছিলো, বারবার বলছি জয়ি। প্রতিভা না থাকলে ভূদেবদার মতো অমন খুঁতখুতে লোক তোমার প্রথম ছবিটাই কিনে নিতেন না। আর শুধু ঐটুকু কেনাই তো নয়, কলকাতার লিট্ল্ ম্যাগাজিন ওয়র্ল্ডে আর বিজ্ঞাপন-ইলাস্ট্রেশনের জগতে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কতো মানুষের সাথে কথা বলেছেন শক্তিদা আর ভূদেবদা, তা তো তোমার চেয়ে বেশি কেউই জানেনা। শুধু ঐটুকুই নয়, তোমার প্রতিভার স্ফুরণের জন্যে বোধ হয় ঠিক ঐ সময়টায় একজনের প্রয়োজন ছিলো, এমন একজন যে তোমাকে ঠিক ঠিক দিশা দেখাতে পারবে, যে তোমার দক্ষতার পরের ধাপটায় তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে হাত ধরে। নিখিলেশদার মাধ্যমে তোমাকে বিকাশ ভট্টাচার্যর কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন শক্তিদা। বিকাশ ভট্টাচার্যর মতো এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্র-প্রতিভাদের একজন নিজে তোমার সাথে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন ছবি আঁকার পাঠ দিতে। এ কথা তুমিই আমাকে বলেছো জয়ি যে তোমার তা পছন্দ হয়নি। পালিয়েছিলে তুমি।
বৃত্তরৈখিক (৩০) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৭ এপ্রিল ২০২১ | ১৬৬২ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
যে বৃদ্ধাবাসের প্রস্তাবটা অরুণ দিচ্ছেন, ধরুন সেই একই বৃদ্ধাবাসে একটা ব্লক তৈরি করা হলো যেটা নিঃশুল্ক। আর, সেই ব্লকটায় থাকবেন শুধুমাত্র একা-হয়ে-যাওয়া ট্রাইবাল মানুষজন। এই ধরণের বৃদ্ধাবাসে সাধারণত নিয়মিত চিকিৎসার জন্যে একটা ব্যবস্থা থাকে। এ ক্ষেত্রেও সেটা থাকবে, কিন্তু অন্য বৃদ্ধাবাসের তুলনায় এটা একটু অন্যরকমের হতে পারে। এমন হতে পারে যে বৃদ্ধাবাসের আবাসিক যারা নয়, স্থানীয় সেই সব মানুষদের জন্যেও আউটডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো এখান থেকে। সত্যি সত্যিই যদি এইরকমের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আপনাদের সমাজসেবার কাজটা এই বৃদ্ধাবাস দিয়েই শুরু হতে পারে।
বৃত্তরৈখিক (৩১) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ২১৬৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এই ভূগোলের বাইরেও একটা ভূগোল আছে। সে ভূগোল জঙ্গলের মানুষকে নিয়ে। সে ভূগোল যে অঞ্চলের সেই অঞ্চলের যে কোন জায়গা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলেই শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছোট-বড়ো পাহাড়, লালচে মাটি যার অনেকটাই কাঁকুড়ে, অজস্র তিরতিরে ছোট ছোট নদী-ঝোরার গুনগুনানি, আর কালোকোলো বেঁটেখাটো মানুষ – আপনি মাইলের পর মাইল হাঁটুন – এই একই দৃশ্য – মাইলের পর মাইল। কতো মাইল? কতো মাইল আমি ঠিক ঠিক জানিনা, কিন্তু অনেকটাই। এখান থেকে হাঁটতে শুরু কোরে বাঁকুড়া-মেদনীপুরের ভেতর দিয়ে ঢুকে যান সিংভূমে; ঘাটশিলা-জামশেদপুরের কারখানাগুলোর দক্ষিণে এসে ময়ূরভঞ্জ-কেওনঝর-সম্বলপুর হয়ে পশ্চিমে গিয়ে পৌঁছিয়ে যান সুন্দরগড়-রায়গড়-সরগুজা, তারপর আবার পূবের দিকে এসে পালামৌ-হাজারিবাগ-রাঁচি-গিরিডি-সাঁওতাল পরগণা দিয়ে ধানবাদ হয়ে ফিরে আসুন এই পুরুলিয়ায়।
বৃত্তরৈখিক (৩২) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ মে ২০২১ | ২১৮৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
কর্পোরেট অফিস আর কলকাতায় পার্থক্য অনেক। কলকাতায় সোমেশ্বরই ছিল বস, অতএব সাধারণভাবে অফিসের চালচলন, ম্যানেজার আর অন্য কর্মচারীদের মধ্যে সম্পর্ক, ওঠাবসা ইত্যাদি, ঠিক নিয়ন্ত্রণ না করলেও সোমেশ্বরের রুচি আর পছন্দের ছাপও পড়ত তাতে। কর্পোরেট অফিস অন্য রকমের। সেখানে অনেক ডিপার্টমেন্ট, অনেক কমিটি, বিদেশী ভিজিটর্স, নানা রকমের প্রেজেন্টেশন আর পার্টি। বেশির ভাগ কাজের দিনগুলোতেই যেহেতু ট্যুরে থাকে সোমেশ্বর, অতএব নিজের কাজের বাইরের এসব ব্যাপারে ও থাকেই না প্রায়। মুম্বইতে থেকেও এক-আধটা সান্ধ্য পার্টিতে না গেলে চলে না, কাজেই সেটুকুই ওর জনসংযোগ। কিন্তু ওকে যে বিশেষ কেউ লক্ষ্য করে, তা-ও মনে হয়না।
বৃত্তরৈখিক (৩৩) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৮ মে ২০২১ | ২৩১৪ বার পঠিত
ওই কচি বয়েসে স্কুলের পরীক্ষা পাশের পর মেয়ে যেদিন বললো কলেজে পড়বে না ও, ছবি আঁকবে আর ছবিই আঁকবে শুধু, সেদিন মেয়ের কেরিয়ার পরিকল্পনার একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলো হেমন্ত। ঠিক ঠিক যে ব্যাপারটা বুঝেছিলো, তা নয়। ততদিনে জয়ির তুলির সাথে বন্ধুত্ব আর তুলির বাবার প্রায়-মেয়ে-হয়ে-ওঠার ব্যাপারটা জেনেছে ও। ওরা অনেক বড়লোক, অনেক লেখাপড়া জানে; ভেবেছে ওদের সংস্পর্শে নিজের সম্বন্ধে যে পরিকল্পনা করেছে জয়ি, সেটাকে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামের এক কবির সাথে কথা বলে যেদিন জয়ি পাড়ি দেয় কলকাতায়, ও আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। শুধু নিজের জমানো সামান্য টাকা আর বুকভরা আশীর্বাদ ছাড়া ওর কিছুই দেবার ছিলো না মেয়েকে।
বৃত্তরৈখিক (৩৪) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৫ মে ২০২১ | ১৮৮৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
রঘুনাথ বললো কাছাকাছি ভাবকান্দি নামে একটা আদিবাসী গ্রাম আছে, সেখান থেকেই আসে বেশির ভাগ লোক। সেই গ্রামটা, আর যে গ্রামের থেকে আমাদের অষ্টমী আসে গোরুর দেখাশোনা করার জন্যে – ডাংলাজোড়া – এই দুটো গ্রামে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? বাড়ি বাড়ি? আমি তো ওদের সবায়ের ভাষা বুঝবো না, তাই তোমার সাথে যাবো প্রথম প্রথম। ওদের গ্রামে গিয়ে আমি ছবি আঁকবো, আর ওদের বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখাবো।
বৃত্তরৈখিক (৩৫) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২২ মে ২০২১ | ২৩৪৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
জাওয়া ফুল কী জানেন? জাওয়া ফুল আসলে ফুল নয়, তিন বা পাঁচ বা সাত রকমের দানাশস্যের অঙ্কুর, যা তারা বপন করেছিলো নিজের নিজের শালপাতার থালায় সাত দিন আগে, আর অঙ্কুরোদ্গম করিয়েছিলো রোজ সন্ধ্যেতে জল ছিটিয়ে। পুজোর পর চলবে হাঁড়িয়া পান আর সারা রাত ধরে নাচ; নাচে যোগ দেবে মেয়ের দল আর ধামসা-মাদল নিয়ে ছেলেরা। পরের দিন সকালে, ঐ যে মেয়েরা লুকিয়ে রেখেছিলো ভিজে বালিতে দানাশস্য ছড়ানো জাওয়াগুলো, সেগুলোর থেকে অঙ্কুরিত বীজ উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে তারা, আর সেগুলো ছড়িয়ে দেবে নিজের নিজের বাড়িতে। করম উৎসব বন্ধুত্বেরও উৎসব। বীজ ভাগ করা হয়ে গেলে মেয়েরা পরস্পরকে পরিয়ে দেবে রাখী, এই রাখীর নাম করমডোর। এখন থেকে ওরা করমসখী...
বৃত্তরৈখিক (৩৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৯ মে ২০২১ | ১৬৮১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
হলঘর যে দুটো ছিলো, যেখানে জয়ির ছবির এগজিবিশন হয়েছিলো, তার মধ্যে একটাকে এখন বানানো হয়েছে ডাইনিং হল, লম্বা একটা টেবিল, দু সারি চেয়ার আর ছোট একটা কাঠের আলমারি। আগে যে দুটো অফিস ঘর ছিলো তার মধ্যে একটাকে চিকিৎসালয় বানিয়ে নিয়েছে সুকান্তদা। ডাক্তারের টেবিল, সামনে রোগী আর তার সঙ্গী বসার জন্যে দুটো চেয়ার। একটা চাদর দিয়ে ঘরটা ভাগ করে তার আড়ালে রোগী পরীক্ষার ব্যবস্থা। সেখানে টেবিলের নীচে একটা ওজন নেবার যন্ত্র। ডাক্তারের টেবিলে স্টেথোস্কোপ, একটা কাচের গ্লাসে থার্মোমিটার, প্রত্যেকবার এসেই কোন একটা তরল ঐ গ্লাসে ঢেলে থার্মোমিটারটা তাতে ডুবিয়ে দেয় সুকান্তদা, অন্য একটা গ্লাসে আরও কিছু টুকিটাকি। কাছাকাছি গ্রাম দুটোর মানুষরা এতদিনে সবাই জেনে গেছে এই ডাক্তারবাবুর কথা। ভীড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে যেতে হয়।
বৃত্তরৈখিক (৩৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৫ জুন ২০২১ | ১৭০৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
যে মীটিং হলো এবার তাতে সুকান্তদা আর জুঁইদি আসেনি, ওদের আশাও করেনি জয়ি। শ্যামলিমাও আসতে পারেনি, ওর শ্বশুরবাড়িতে কিছু একটা উৎসব আছে, ওরা সপরিবার গেছে সেখানে। তুলিও যথারীতি অনুপস্থিত। গেস্ট হাউজটা নিয়মিত চালাতে হবে, মীটিঙে যারা ছিলো সবাই একমত। সিনেমার লোকরা যদি শেষ পর্যন্ত পছন্দ করে খুশিঝোরাকে, সেটাও খুশিঝোরার পক্ষে, অন্তত আর্থিক ব্যাপারটা মাথায় রাখলে, ভালোই হবে, বললো প্রায় সবাই; বিশেষ করে মাত্র এক রাত্তির গেস্ট হাউজে থেকে যে টাকাটা ওরা দিয়েছে, সেটা তো অভাবনীয়, বললো কোষাধ্যক্ষ অনলাভ। সবাই সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহী, শুধু নীরব জলধর। ও ঠিক জানে না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো ওর সিনেমার ব্যাপারটায়, কী অস্বস্তি স্পষ্ট করে বোঝাতে পারবে না, কাজেই চুপ করে থাকাই ওর মনে হলো ভালো।
বৃত্তরৈখিক (৩৮) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১২ জুন ২০২১ | ২৭১০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
হঠাৎ যুবকদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করে, এখানে যদি থেকে যেতে চাই আমরা দুদিন, কাছাকাছি অ্যাকোমোডেশন কোথায় পাবো?
এখান থেকে বাঁ দিকে গিয়ে মাইল আষ্টেক দূরে বান্দোয়ান নামে একটা ছোট শহর আছে, সেখানে শুনেছি পি-ডব্ল্যু-ডি-র একটা ডাক-বাংলো গোছের কিছু আছে, খোঁজ করে দেখতে পারেন। বাঁদিকে না গিয়ে যদি ডান দিকে যান, তিন-চার মাইলের পর সাত-ঘুরুং নদীর কাছে একটা সরকারি ট্যুরিস্ট লজ গোছেরও আছে শুনেছি। এ ছাড়াও যেখানে বসে আছেন সেই চৌহদ্দির মধ্যে চারখানা ঘর আছে, তবে তা কী পছন্দ হবে আপনাদের?
বৃত্তরৈখিক (৩৯) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৯ জুন ২০২১ | ২২৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
এইবার এই চারটে অ্যামাউন্ট আলাদা আলাদা বাণ্ডিল করে একটা একটা খামে ঢুকিয়ে রাখো, জয়ি ড্রয়ার খুলে কতকগুলো খাম বের করে, আর রাবার ব্যাণ্ড। নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে উৎপল। জয়ি বলে, এদিকে এসো, আমার পাশে। উৎপল চেয়ার ছেড়ে উঠে জয়ি যেখানে বসে আছে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জয়ি চাবি দিয়ে একটা ড্রয়ার খোলে, উৎপলকে বলে, এই টাকার বাণ্ডিলগুলো আর তোমার হিসেবের কাগজটা এই ড্রয়ারে রাখো। এবার চাবিটা দেয় উৎপলকে, ভালো কোরে চাবি দাও। চাবি দেওয়া হয়ে গেলে ওর কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে নিজের ব্যাগে ঢোকায় জয়ি, বলে, টাকাগুলো ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে, ব্যাঙ্কে গিয়েছো কখনো?
বৃত্তরৈখিক (৪১) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৩ জুলাই ২০২১ | ১৮৩৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
সুদীপ্তরা খুশিঝোরা থেকে ফিরে যাওয়ার মাসখানেক পর একটা পত্রিকা এসে পৌঁছোয় জয়ির কাছে, পোস্ট অফিস মারফত। শিল্প-সাহিত্য-সমাজ বিষয়ক লিট্ল্ ম্যাগাজিন ঝলক, জয়ি কখনো সখনো এক-আধ কপি দেখে থাকতেও পারে, মনে করতে পারে না। এই সংখ্যা সুদীপ্ত রায়ের একটা প্রবন্ধ গোছের লেখা প্রকাশ করেছে, নাম মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য। চিত্রশিল্পী জয়মালিকা সেন পুরুলিয়ার এক প্রান্তে আদিবাসীদের শিল্প-সংস্কৃতি প্রসারের যে বিপুল কাজ করছেন তাঁর খুশিঝোরা সমিতির মাধ্যমে, তা যে শুধুমাত্র একজন ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলেছে সুদীপ্ত।
বৃত্তরৈখিক (৪২) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১০ জুলাই ২০২১ | ২০৯১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
উৎপল জানতো পলিথিনের ব্যাগে লাউয়ের বীজ থেকে চারা তৈরি করতে হয়, নিজের হাতে আগে করেনি কখনো। গোয়াল থেকে পচা গোবর নিয়ে এলো শুকি, মাটি আর বালির সাথে সেটা মিশিয়ে তৈরি হলো জমি, বীজ বপন করা হলো তাতে। জলধর বললো ব্যাগের নীচে ফুটো করে দাও দু-তিনটে, ওখান থেকে জল ঝরে যাবে। বীজ থেকে চারা, তারপর সুস্থ সবল চারাগুলোকে মাটিতে পুঁতলো ওরা। পুকুর-পাড়ের মাটি তো শুকিয়েই গিয়েছিলো এতদিনে, সেই মাটিকে একটু ঝুরঝুরে করে নেওয়া হলো, দেখতে দেখতে চারাগুলো বেড়ে উঠলো বেশ খানিকটা। এবার শুকির কাজ, চারাগুলোর গায়ে গায়ে কঞ্চি বেঁধে দেওয়া। চারা আর একটু বড়ো হলে কঞ্চির ওপর মাচা, মাস দুয়েকের মধ্যেই ফল !
বৃত্তরৈখিক (৪৩) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৭ জুলাই ২০২১ | ১৮৭৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
জলধর বলে একদিন, সবই তো হচ্ছে জয়িদি, কিন্তু টীচারের কী হবে ! স্কুলে এখন এতোগুলো বাচ্চার জন্যে রান্না করতে হয় রোজ, তাছাড়া গেস্ট হাউজের ঘরগুলোও তো প্রায়ই ভর্তি থাকে আজকাল। বান্দোয়ান থেকে নিমাই নামের একজনকে নিয়ে এসেছে জলধর, সে রঘুনাথকে সাহায্য করে। তাছাড়াও লকি-শুকি। এমনকী প্রতুলবাবুও এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে, কাজেই অসুবিধে হয় না। পুকুরপাড়ে লাউ কেন, এখন কুমড়ো আর বেগুনও হচ্ছে, গাছপালা যা লাগানো হয়েছিলো সবই বাড়ছে তরতর কোরে ! গেটের উল্টো দিকে লকিশুকিদের জমিতে তৈরি গোয়ালে এখন আরও কয়েকটা গোরু, এমনকী মোষও দুটো! সবই হচ্ছে জয়িদি, স্কুলের টীচারের কী হবে?
বৃত্তরৈখিক (৪৪) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৪ জুলাই ২০২১ | ১৯৫৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে উৎপল, আর কোদাল হাতে স্কুলের আটটা বাচ্চা লেগে যায় মাটি কাটার কাজে। আটটার মধ্যে তিনটে নেহাৎই দুবলা, ওদের দিয়ে মাটি কাটানো যাবে না। ওরা শুধু কাটা মাটি সরিয়ে সরিয়ে রাখবে। আর মেয়ে তিনটে পুকুর থেকে জল নিয়ে এসে মাঝে মাঝে মাটিতে ঢেলে মাটি নরম রাখবে। ঘন্টায় ঘন্টায় ছুটি, তখন প্রাণ ভরে জল খাওয়া, সঙ্গে মুড়কি আর বাতাসা। তিন ঘন্টার পর গরম ফেনা ভাত আর আলুভাতে। তারপর আবার কাজ, কিন্তু ঘন্টায় ঘন্টায় জল খাওয়ার ছুটিটা থাকেই। দুপুরে ভাতের সাথে ডাল থাকে, সঙ্গে একটা সবজিও। সন্ধ্যের আগেই কাজ শেষ। চানটান সেরে জামাকাপড় বদলিয়ে বাচ্চারা বসে ডাইনিং হলের মেঝেতে খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে। পাশে একটা চেয়ার পেতে বসে জয়ি, এখন লেখাপড়ার সময়। লেখাপড়া কিন্তু এগোয় না বেশি দূর, ক্লান্ত বাচ্চারা ঢুলতে থাকে একটু পরেই।
বৃত্তরৈখিক (৪৫) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩১ জুলাই ২০২১ | ২১১৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
এই লাইনের মানে কী হলো? – জলধর বলে, ধারমুর শেখানো করম পুজো আমরা এখন সবাই মানি; মানি, তাই বাঁচি মাথা উঁচু করে। অনেক দিন আগে, তা প্রায় একশো বছর হবে, আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিজেদের ভাষা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। তখন ইংরেজ আমল, আমাদেরই জঙ্গলের জমি কেটে খনি বানিয়ে ওরা আমাদের বাপ-দাদাদের তখন কুলি বানাচ্ছে, হাজার মাইল দূরে ওদের চা-বাগানে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কুলির কাজ করার জন্যে, আর আমাদের বাপ-দাদারাও নিজেদের ভাষা ভুলে ওদের ভাষাই শেখার চেষ্টা করছেন। সেই সময়ে জন্ম নিলেন এক আশ্চর্য মানুষ যিনি অনুভব করলেন মাতৃভাষা মানুষের কাছে কত বড়ো সম্পদ।
বৃত্তরৈখিক (৪৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৭ আগস্ট ২০২১ | ২০০৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
ক্লাস ফোর-এ বসেই পাশের ঘর থেকে প্রতুলবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ক্লাস টূ আর ক্লাস থ্রী একসাথে বসিয়ে পড়াচ্ছেন তিনি। শোনা যায় ছেলেমেয়েদের সমবেত কণ্ঠস্বরও। তারা মুখস্থ করছে কিছু একটা। সম্ভবত ইংরিজির পাঠ। এ-এন-টি অ্যান্ট, অ্যান্ট মানে পিঁপড়ে, তারপরেই এ-জি-ই এজ, এজ মানে বয়স, এবং পরেরটাই এ-ডবল এস অ্যাস, অ্যাস মানে গাধা। ছেলেমেয়েরা কী শিখছে বোঝা যায় না, কিন্তু ছাত্রশিক্ষকের সমবেত পরিশ্রমকে শ্রদ্ধা না কোরে পারা যায় না ! নিলীন স্থির করে এবার মেদনীপুর ফিরে গিয়ে ও নিজে যে স্কুলে পড়েছিলো সেখানকার শিক্ষকদের সাথে একটু আলোচনা করবে।
বৃত্তরৈখিক (৪৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৪ আগস্ট ২০২১ | ২১২৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
ছেলেগুলো আসলে গণ্ডগোল করার মতলবেই এসেছিলো। বললো, চব্বিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে না হলে আগুন জ্বালিয়ে দেবো। এখানকার এস-ডি-পি-ও কে চিনতাম আমি, ডি-এস-পি কেও চিনি, খবর দিলে হয়তো সাহায্য পেতাম, কিন্তু সে রাস্তায় যাইনি। সেদিন গেলাম না কলকাতায়। একজন মিস্ত্রীকে চিনতাম, যে আমাদের টয়লেট অনেকগুলো তৈরি করেছে। খোঁজ করে করে তাকে ধরলাম, সেপটিক চেম্বার সারাবার ব্যবস্থাটা হলো। বান্দোয়ানের হাসপাতালে গেলাম, কোনই ব্যবস্থা করা গেলো না। মিস্ত্রী বললো, কাউকে দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করিয়ে যদি ঢাকাঢুকি দিয়ে কোথাও রেখে দিতে পারি, ও পরের দিন সেগুলো সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর কী করলাম জানেন? গোটা কয়েক ড্রাম কিনে বান্দোয়ান থেকে ফিরলাম।
বৃত্তরৈখিক (৪৮) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২১ আগস্ট ২০২১ | ১৬৮৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
জীবনে কষ্ট তো কম করেনি সম্ভৃতা। সেই অতটুকু বয়েসে যখন সোমেশ্বরের সাথে সংসার শুরু করেছিলো নন্দী স্ট্রীটের এক কামরার ফ্ল্যাটে, কীই বা জানতো সংসারের ! তারপর এ শহর ও শহর ছোটবড়ো নানান রকমের আস্তানা আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা পেরিয়ে, অভিজাত কর্পোরেট আবাসন এয়ারকণ্ডিশন্ড্ গাড়ি আর আনুসঙ্গিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে আসা জীবন ছেড়ে, এক কথায় আবার কলকাতায় ফিরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু ! চাকরি করবে না আর সোমেশ্বর ! পলায়নরত মূলধনের ক্ষয়িষ্ণু কলকাতা শহরেই সে পেশার শেষ পনের-ষোল বছর বিপণন পরামর্শদাতার কাজ করলো !
বৃত্তরৈখিক (৪৯) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৮ আগস্ট ২০২১ | ১৪৮১ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
সকাল নটা নাগাদ জলখাবার। চানটান করে তৈরি হয়ে ডাইনিং হলের দিকে যেতে গিয়ে জয়মালিকাকে দেখতে পায় সোমেশ্বর আর সম্ভৃতা, নিজের ঘরের বাইরের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে সে। গূড মর্ণিং, বলে সম্ভৃতা এগিয়ে যায়, তার পেছনেই সোমেশ্বর। জয়মালিকার ঘরের পাশের ঘরটায় একটা জানলা আছে, যেটা খোলে বারান্দাটায়। সেই জানলার সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের বড়ো ছেলেমেয়েরা, হোস্টেলে যারা থাকে, সবাই। ছেলেমেয়েরা ওদের চেনে, আগে কয়েকবার আসায় দেখা হয়েছে ওদের সাথে। দেখা হতেই বলে, গূড মর্ণিং স্যর, গূড মর্ণিং ম্যাডাম। কী ব্যাপার, লাইন কিসের? – জিজ্ঞেস করে সোমেশ্বর।
বৃত্তরৈখিক (৫০) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ২০৯৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
প্রতুল বাবু বলেন, ঠিক রুটিন কিছু নেই সোমদা, আপনি আর সোমদি যে যে ক্লাসে পড়াতে চান, চলে যান। তারপর আমি আর মুজফ্ফর যাবো। ইংরিজি প্রায় পড়ানোই হয়নি কখনো, যে দুয়েকজন একটু-আধটুও জানে তাদের মুজফ্ফর আর আমি আলাদা করে ক্লাসের বাইরে গাইড করার চেষ্টা করেছি। বাকিরা কিছুই জানে না প্রায়। বাংলার অবস্থাও খুবই খারাপ, তবে বোধ হয় ইংরিজির মতো অতটা নয়। ক্লাস ওয়ানে রাজীবই যাক, ওটা ও-ই ম্যানেজ করতে পারে ভালো।
বৃত্তরৈখিক (৫১) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮২১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আগস্টের শেষে যখন তিন-চারদিনের জন্যে কলকাতায় গেলো সোমেশ্বররা, ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের এই উপলব্ধির কথাই বললো ওরা। অতল দারিদ্রসীমারও নীচের মানুষ যারা, তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসে পড়াতে গেলে – এবং তা-ও সরকারি সাহায্য ছাড়া – হয়তো জয়মালিকা সেনের রাস্তাই ঠিক ঠিক রাস্তা, এই পথে চলতে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবে সহজ-খ্যাতির যে চোরাগলিগুলো, সেগুলোকে অতিক্রম করাই এখন সাধনা ওদের। যে ছেলেমেয়েদের কাছাকাছি পৌঁছোবার ক্ষমতাই ছিলো না ওদের, জয়মালিকা সেন তাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ তো কোরে দিয়েছেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগাতেই হবে।
বৃত্তরৈখিক (৫২) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৯০০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
অস্বস্তিকর নীরবতাটা ভাঙাতেই বোধ হয় কবিদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, আচ্ছা জয়মালিকাদি, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে? আমরা তো অনেকদিন ধরেই আসছি এখানে, দুটো পরিবর্তন খুব চোখে পড়ে আজকাল। প্রথমটা হলো আপনার রুচির পরিবর্তন। আমরা বরাবর দেখেছি আপনি মাছ-মাংস ভালোবাসতেন, বিশেষ কোরে খাসির মাংস। এখানে খাসির মাংস ভালো পাওয়া যায় না, কতোবার বেড়াতে বেড়াতে কোন গ্রামের হাটে ভালো মাংস দেখে আমরাই নিয়ে এসেছি আপনার জন্যে, মনে আছে? অথচ এখন সেই আপনিই মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, এটা কেন? আর দ্বিতীয় যে পরিবর্তন সেটা তো একেবারে মূলে।
বৃত্তরৈখিক (৫৩) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৫৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
পরিবেশটা সহজ করার জন্যেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক উৎপল ঘোষণা করে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখন একটা সাঁওতালি গান শোনাবে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত পরিবেশিত হয় ধারমু উদুঃক্ আকাৎ লেকা গানটি। গান শেষ হলে জয়মালিকা আবার তুলে নেয় মাইক। সে ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের থেকে যারা এসেছে তাদের উদ্দেশে এবার বলে তোমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। তারা লেখাপড়া যেমন শিখবে সব ধরণের কাজও শিখবে তেমনি। এই যে আজ এখানে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, মাইক লাগানো হয়েছে, এসব তোমাদের ছেলেমেয়েরাই করেছে। বড়ো বড়ো শহরের ছেলেমেয়েরা যেমন শেখে সেরকমই ভালো ইংরিজি আর বাংলা শেখাবার জন্যে আমাদের স্কুলে এখন কলকাতা থেকে এসেছেন সোমেশ্বর স্যর আর সম্ভৃতা ম্যাডাম।
বৃত্তরৈখিক (৫৪) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০২ অক্টোবর ২০২১ | ১৬০৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
দুপুরের খাওয়া চল্লিশজন ছেলেমেয়ের জন্যে, ফাইফ সিক্স সেভেন আর এইট। পেট-ভরা ভাত দেওয়া হয় ওদের, সকালের মতো ফ্যানা-ভাত নয়, ফ্যান-গালা ভাত। আর মনে রাখবেন, ওদের পেট-ভরা মানে আপনাদের পেট-ভরা নয়। ভাত ওরা অনেক বেশি খায়, এবং যতটা খায় ততটাই দেওয়া হয়। আমার মনে হয় না পেট-ভরা নিয়ে কোন দুঃখ ওদের আছে। পেট ভরে। রোজই। তবে হ্যাঁ, তরকারির একটা মাপ আছে, সে মাপটা বুঝিয়ে দেওয়া আছে নিমাই আর সুনীলকে। সেটা যে যথেষ্ট নয়, তা আমরা সবাই জানি, নিমাই আর সুনীলও জানে।
বৃত্তরৈখিক (৫৫) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৯ অক্টোবর ২০২১ | ১২৬৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
দুপুরে খাওয়ার সময় পুলকেশও বসেন ওদের সাথে, এবং পুলকেশের বিশেষ অনুরোধে জয়মালিকাও। য়্যোরোপের গল্প হয়, পাঁচ জায়গায় সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছে জয়মালিকা, ধরণী মাতার আরাধনা যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর ভারতের ইণ্ডিজেনাস পপুলেশনের দার্শনিক চিন্তার মহাসম্মিলনের ফসল, ভারতীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রতীক, আদিবাসী ধর্ম আর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মিলনস্থল, এ চিন্তা নাকি আলোড়ন তুলেছে যেখানে যেখানে গেছে ও সেখানেই। ও যে বক্তৃতা দিয়েছে তার ইংরিজি অনুবাদ, এক একটি কপি পাঁচ য়্যুরো হিসেবে একশো কপি – যা ও সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়েছিলো – সবই বিক্রি হয়ে গেছে ! এসব আলোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলে না সোমেশ্বরের ওপর, ও মনে মনে ভাবছিলো জয়মালিকা কী বাচ্চাদের পাদুকাবিহীন ফাটা-পাগুলো লক্ষ্য করেছে আজ !
বৃত্তরৈখিক (৫৬) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৩ অক্টোবর ২০২১ | ১৩৫২ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
মিনতি, মিনতির মতো মুখচোরা মেয়ে, সে-ও জিজ্ঞেস করেছে, কতো তাড়াতাড়ি? কতো তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে হবে? তখনো ধৈর্য হারায়নি উৎপল, বলেছে আটটার মধ্যে। তখন লক্ষ্মীকান্ত বলেছে, ঠিক আছে, আমরা ছটার সময় পড়তে বসে যাবো, আটটার মধ্যে পড়া হয়ে যাবে। উৎপল তো কখনও এরকম জবাব দিতে শোনেনি ওদের, ও রেগেমেগে বলেছে, কী পড়তে বসে যাবো পড়তে বসে যাবো করছো, একজনও বসবে না ডাইনিং হলের চেয়ারে। তখন নাকি তিন-চারজনে মিলে একসাথে বলেছে, ঠিক আছে স্যর, আমরা মেঝেতে বসবো। আর তারপর আস্পর্ধা দেখুন, ক্লাস সেভেনের নবীন ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছে তখন, স্যরকেও কী মেঝেতে বসতে হবে ! বিশেষ কোরে নবীনের এই প্রশ্নে উৎপল খুবই আপসেট। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমিও একটু শঙ্কিত।
বৃত্তরৈখিক (৫৭) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩০ অক্টোবর ২০২১ | ১৪০৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
প্রথম যে কথা বলছিলো সে-ই শুরু করে আবার, ঠিকই, তবে এই সব পরিবর্তন আজকাল হয়েছে। একেবারে প্রথমের দিকে কিন্তু এখনকার ডাইনিং হলটায় শুধুমাত্র কয়েকটা বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলটা শুরু করেছিলেন জয়িদি। তারপর বাস এলো। বাসটা আসার পর থেকে একটা দারুণ কাজ শুরু করলেন উনি, একেবারে জঙ্গলমহলের ভেতরের গ্রামগুলোর থেকে একটা একটা করে বাচ্চাকে ধরে নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আমরা স্কুলের বাসে গিয়েও দেখেছি কেমন সব গ্রাম। শুনেছি তখন জলধর নামে এক সাঁওতাল যুবক ছিলো জয়িদির সঙ্গে, সে নাকি পড়াতোও ভালো। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর থেকে আর নিয়মিত পড়াবার মতো ভালো লোক জোগাড় করা যায়নি।
বৃত্তরৈখিক (৫৮ - শেষ পর্ব) : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৪৫৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
বৃত্তরৈখিকের শেষ পর্ব আজ। লেখকের কথায়ঃ "বৃত্তরৈখিককে উপন্যাস বলেছি, কিন্তু হয়তো ইতিহাসও বলা চলতো। মোটামুটি বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের গোড়ায় যাঁদের যৌবনের শুরু এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বেড়ে ওঠা, বাংলাভাষী সেই মধ্যবিত্তদের একদলের ইতিহাস এই রচনার রসদ। পাঠযোগ্যতার খাতিরে একটা গল্পের বুননের চেষ্টা এতে আছে – উপন্যাস নামের আকাঙ্খা সেখানেই – সেটা কতটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে পাঠকই তা বলতে পারবেন। কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের পুর্ববর্তী প্রজন্মের কথা কোন কোন ক্ষেত্রে গল্পের খাতিরে এসে পড়লেও এই ইতিকথার প্রধান চরিত্ররা মোটামুটি ভারতের স্বাধীনতার সমবয়েসী। এবং এই স্বাধীনতার মতই আশাবাদিতা এবং নৈরাশ্য, আদর্শ এবং আদর্শচ্যুতি, মেধানিষ্ঠা এবং নিম্নগামী মেধা এখানে পাশাপাশি উপস্থিত।"
সীমানা - ১ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৯ মার্চ ২০২২ | ৩৫৬৭ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
খবর শুনে মা কাঁদল না, তবে পরের দিন আমাদের বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। পেট পুরে খেল ওই দুজন লোক, তারপর চলে গেল। আমি ততদিনে সেকেণ্ড ক্লাশ, মানে ক্লাশ নাইন-এ উঠেছি। মা আমাকে বলল, আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর যেতে হবে মেসপটমা না কী বলে, সেই আরব দেশেই। শুধু আমাকে বলেই ক্ষান্ত হল না মা, বস্তির সবাই জানল পিংলাকে তার মা যুদ্ধে পাঠাবে। আমাদেরই বস্তির মাতব্বর গোছের একজন শুধু মাকে সাবধান করে দিল, এখনই কিছু কোরো না, কেউ যদি বলে দু পয়সা খরচ করলেই সে তোমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে, বিশ্বাস কোরো না তাকে। আঠের বছর অন্তত বয়েস না হলে যুদ্ধে নেয় না। আর তা ছাড়া সাহেবরা সব দেশের ছেলেদের নেয়, কিন্তু বাঙালিদের নেয় না যুদ্ধে। বাঙালিদের জন্যে শুধু ইশকুল আপিস আর কোর্টের কাজ, সাহেবরা বাঙালির হাতে বন্দুক দেবে না।
সীমানা - ২ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০২ এপ্রিল ২০২২ | ৪০৪৯ বার পঠিত
সেই আঠেরোশো পঞ্চাশ-টঞ্চাশ থেকে আমাদের এই বাংলার গ্রাম থেকে – আর বাংলাই বা বলি কেন – বিহার উড়িষ্যা বা এমনকি যুক্তপ্রদেশ থেকেও দলে দলে গরীব মানুষ কাজের সন্ধানে আসছে এই কলকাতা সহরে। এদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দু' দলই আছে। মুসলমানই বেশি বলে আমার মনে হয়, কারণ তারাই অপেক্ষাকৃত বেশি গরীব। কলকাতায় এরা সব থাকে কোথায়? প্রথম-প্রথম ফুটপাতে, আর তারপর নানা বস্তিতে। আমি শুনেছি ভদ্রলোকদের চাপে আঠেরোশো ছিয়াত্তর-টিয়াত্তরে কলকাতার কর্পোরেশন নানারকমের নাগরিক সুখ-সুবিধের ব্যাপারে সহরবাসী মানুষদের একটা অধিকার দিয়েছে। কী অধিকার? একটা কর্পোরেশন পরিচালক সমিতি, যার আসল নাম কাউন্সিল, তার সভ্য হওয়া। তার মানে কাউন্সিলর হবার অধিকার। এবং অবশ্যই, ভোট দিয়ে সেই কাউন্সিলার নির্বাচন করা। এই ভোটের অধিকার কিন্তু আছে মাত্র তিন ধরণের লোকের।
সীমানা - ৩ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৬ এপ্রিল ২০২২ | ৪০৬১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
কাজী উত্তর দেবার আগেই উঠে দাঁড়ান ডঃ শহীদুল্লাহ্, বলেন, আমার এবার যাবার সময় হল। যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলি কাজী। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখন তোমার পরিচয় হওয়া দরকার। সুধাকান্তবাবু বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কবে যে ওঁকে পাওয়া যাবে আমি ঠিক জানি না। শুনেছি, বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে ফিরেছেন। ইদানীং প্রায়ই বিদেশে যাচ্ছেন, কাজেই এর পরের বিদেশ যাত্রার আগেই ধরতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, এক-দেড় মাসের মধ্যেই ধরতে চাই। জোড়াসাঁকোয় নয়, চেষ্টা করব শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করতে, সেখানে উনি অনেক খোলামেলা। তুমি আমার সঙ্গে আসবে তো?
সীমানা - ৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩০ এপ্রিল ২০২২ | ৩৮০৮ বার পঠিত
কিছু ঠিকই, কিন্তু সেই কিছুটা কী? খুলেই দেখা যাক, বলতে বলতে বাটিটা তুলে নিয়ে চাপা দেওয়া থালাটা সরিয়ে দেয় নজরুল। এক বাটি আলুর দম, কড়া মশলায় বেশ লালচে দেখাচ্ছে। দে গোরুর গা ধুইয়ে – উচ্ছ্বসিত নজরুলের চিৎকৃত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাহ্মুদের দোকান থেকে রুটি নিয়ে আয় শৈলজা, রাত্তিরের ডিনারটা জমে যাবে। তারপর মোহিতলালের দিকে ফিরে বলে, স্যার, ক’খানা রুটি আপনার জন্যে?
সীমানা - ৫ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৪ মে ২০২২ | ৩৯০৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
খাপরার চালের প্লাস্টারহীন বাড়িটায় ঢুকে অবাক হল নজরুল। দরজা পেরিয়ে একটা উঠোন গোছের। ঝকঝক তকতক করছে উঠোনটা। উঠোনে দাঁড়িয়ে সোজা তাকালে একটা খোলা বারান্দা। সামনে, বাঁয়ে, ডাইনে। বারান্দায় বেশ কয়েকটা তোলা-উনুন। আর বারান্দার শেষে অনেকগুলো দরজা। খোলা কোনোটা, কোনোটা ভেজানো, আধ-খোলা কোনোটা বা। কোনও কোনও দরজার পাশের দেওয়ালে এমনকি হাতে-আঁকা আলপনা গোছের ছবিও দেখতে পাওয়া যায়। নজরুল বুঝল, একই সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বারান্দা পেরিয়ে প্রত্যেকটা দরজা এক-একটা পরিবারের আলাদা আলাদা ঘরের। খোলা দরজা দিয়ে একটা ঘরের ভেতর চোখ গেল নজরুলের। মেঝেতে বঁটি পেতে সবজি কুটছে একটা মেয়ে।
সীমানা - ৬ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৮ মে ২০২২ | ৩৫৫১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
সত্যি কথা বলি কাজীদা, আস্তে আস্তে কেমন ভালই লেগে গেল শিবপুরকে। ননী জেঠুর অনুমতি নিয়ে আরও দুয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই, হাতখরচের টাকা উঠে যায়। নানা মানুষের সঙ্গে মিশি, সাহিত্য সভায় যাই, লাইব্রেরিতে কিছু কাজের দায়িত্ব পাই, গান্ধি বিফল হলে যে লড়াই লড়তে হবে, তার আঁচ গায়ে লাগে, মিছিল-মিটিংয়েও যাই। পিংলার সঙ্গে তো সেইভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিন। করাচির কথা, আপনার কথা সব শুনেছি। একদিন বলল আপনার ‘নবযুগ’-এর কথা। মাঝেমধ্যে গঙ্গা পেরিয়ে ‘নবযুগ’ কিনেও আনে। সেই ‘নবযুগ’ পড়িয়েছি একজনকে। আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন। কাল আসবেন একবার?
সীমানা - ৭ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১১ জুন ২০২২ | ৩৬১০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
আপনি যে একদিন বিখ্যাত হবেন তা আমার জানা ছিল, আমি মুজফ্ফর সাহেবকে বলছিলুম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন দেশবিখ্যাত এক লেটোশিল্পী হবেন। এখন তো দেখছি আপনি একজন দেশবিখ্যাত লেখক কবি এবং গায়ক, প্রায় ঠিকই ছিল আমার ধারণাটা। কিন্তু আপনি কি জানেন, ছেলেবেলায় আলাপ না হওয়া সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে মনে রেখেছি? আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম আমি নাকি এক ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছিলুম। ফকির মানে কী, আমি জানতুম না তখন। কিন্তু আপনার বাবা তো অজয়ের দুপারেই বিখ্যাত ছিলেন। আমি যখন শুনলুম তাঁর নাম ফকির আহ্মদ, কেউ না বলা সত্ত্বেও আমি ধরে নিলুম, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ফকির, এঁর আশীর্বাদেই আমি জন্মেছি।
সীমানা - ৮ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ জুন ২০২২ | ৩৪৫৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
আসল কারণটা অন্য। গতকাল ওই যে খিলাফৎ কমিটির নোটিশটা ছাপানো হয়েছিল, সেটার জন্যেই বন্ধ করল কাগজটা, রাগ আর সামলাতে পারল না। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ওই নোটিশ কাল বসুমতীতেও বেরিয়েছে? কই, তাদের তো বন্ধ করেনি। কিন্তু, সে যাই হোক, করেছে, ভালোই হবে। আজকের কাগজের জন্যে যে এডিটরিয়ালটা লিখেছিলাম – দুর্যোগের পাড়ি – সেটা মোসলেম ভারতে ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। নবযুগকে আজ জুলুম করে বন্ধ করার খবরটা নিশ্চয়ই বেরোবে দুয়েকটা অন্য কাগজেও। যারা এতদিনেও নবযুগ পড়েনি, বাংলা খবরের কাগজের সেই পাঠকদেরও নবযুগের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়বে। এখন যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কাগজটা আবার বের করা চাই। আমার তো মনে হয় একটু কষ্ট করে হলেও ওই দুহাজার টাকা আজই জমা দিয়ে দেওয়া উচিত।
সীমানা - ৯ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৯ জুলাই ২০২২ | ৩৪৭১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
বর্ধমান ছাড়াবার পর নজরুল গান ধরেছে আবার, এমন সময় কামরায় উঠল তিন-চারজন বাউলের একটা দল। শান্তিনিকেতনের পথে রেলের কামরায় এই বাউলরা প্রায়ই ওঠে, আর উঠেই গান গায়। সঙ্গে থাকে তাদের একতারা, আর কোন কোন সময় পায়ে ঘুঙুরও। বাউল, ভিক্ষে করাই এদের পেশা, যাত্রীসাধারণেরও সেটা জানা। ফলে, ঠিক ঠিক চাইতেও হয়না ভিক্ষে, গান শেষ হলে অনেক যাত্রী নিজেরাই ডেকে সাধ্যমতো যা পারে, দেয়। আজ এই বাউলরা উঠে নজরুলের গান শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একটু পর, তাদের মধ্যে একজন গানের সঙ্গে একতারায় মৃদু আওয়াজ তোলে, ঘুঙুরের শব্দে তালও রাখে কেউ। নজরুল চোখ মেলে হাসে, তারপর চোখ বুজে গাইতে থাকে আবারও।
সীমানা - ১০ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৩ জুলাই ২০২২ | ৩১৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আলি আকবর বলল, আমি তো কবে থেকেই বলছি খবরের কাগজে চাকরি করে আপনি আপনার প্রতিভার অপচয় করছেন। ছেড়ে দিন ওসব চাকরি, আপনার উচিত সর্বক্ষণের সাহিত্যসেবী হওয়া। নজরুল পেট চাপড়িয়ে বলল, কিন্তু মধ্যপ্রদেশ কি রাজি হবে? আফজালুল বলল, ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আপনি যদি সাহিত্যের হোলটাইমার হন, আর আপনার যাবতীয় রচনা আমাকে দেন মোসলেম ভারত-এর জন্যে, আমি তাহলে আপনাকে প্রতি মাসে একশো টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। প্রমিস! আপনার প্রতিভার তুলনায় এ-টাকাটা কিছুই নয় আমি জানি, কিন্তু আপনার মধ্যপ্রদেশ মনে হয় শান্ত থাকবে এতে।
সীমানা - ১১ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৬ আগস্ট ২০২২ | ৩০৪০ বার পঠিত
আম গাছটা খুঁজে পেতে যে অনেকটা সময় গেল এমন নয়। নজরুল অবাক হয়ে দেখে, এই যে ছ-সাত বছর বাদে সে ফিরে এসেছে দরিরামপুরে, কিছুই যেন বদলায়নি। এই আমগাছটা, এর সামনের পুকুরটাও তো ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে বসে বসেই দূরে বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িটা দেখা যায়, বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছটা একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায় গেল মাঝখানের এতগুলো বছর! নজরুলের মনে হয়, সে যেন স্কুলের পর ওই বাড়িটাতেই কোনরকমে বইখাতাগুলো রেখে দৌড়ে এখানে এসে বসলো এইমাত্র। সূর্য অস্ত যাবার আর বেশি দেরি নেই, লালচে আকাশের রং পুকুরের জলে পড়ে নিস্তরঙ্গ জলটারও রংও বদলিয়ে দিল। এরই মাঝে এক দঙ্গল কিশোরীর কলধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে পুকুর-পার। ওরই মধ্যে শ্যামলা একটি মেয়ে, বন্ধুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোধ হয় নজরুলের দিকে তাকিয়ে নিল একটা মুহূর্তের জন্যে। তার শিথিল বেণী থেকে কি খসে পড়ল একটা ছোট্ট মাথার কাঁটা? কবে যেন সেই ছোট্ট কাঁটাটাকে বুক-পকেটে ভরে নিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল নজরুল তার ছোট টিনের বাক্সটায়। তারপর চুরুলিয়া-আসানসোল-শিয়ারশোল-কলকাতা-নৌশহরা-করাচি হয়ে আবার কলকাতায় যখন ফেরে নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায়, তখন ওর জিনিসপত্রের মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদের চোখে পড়ে যায় এতদিন-ধরে-যত্ন-করে-রেখে-দেওয়া ওই মাথার কাঁটা!
সীমানা - ১২ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৭ আগস্ট ২০২২ | ৩১০৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে।
সীমানা - ১৩ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৯৩১ বার পঠিত
বিয়ের দিন স্থিরই হয়ে গেল, শুভস্য শীঘ্রম যেমন বলেছিল আকবর। জ্যৈষ্ঠ পেরিয়েই। আষাঢ়ের তেসরা। আসমতুন্নেসা মেয়েকে নিয়ে এখন এই বাড়িতেই থাকছে, বিয়ে মামাবাড়ি থেকেই হবে। নজরুলের আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া হবে কীভাবে, জানতে চাইলেন আলতাফ আলি। আমার কোন আত্মীয় নেই, বলে নজরুল, কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারই আমার আত্মীয়, বিরজাসুন্দরীই আমার মা, ওঁদের জানান। আলতাফ বলে, তাহলে কুমিল্লায় চলেই যাই, ওঁরা তো আমাদেরও আত্মীয়, বিশেষ করে আকবরের আর আমার। নজরুল বলে, যাবার আগে আমাকে বলবেন, আমি একটা চিঠি লিখে দেব মাকে।
সীমানা - ১৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ অক্টোবর ২০২২ | ২৮২৮ বার পঠিত
নজরুল চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা, বলে, আলি যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমাকে, আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলুম, আপনি কি আপনার ভাগ্নীর মতামত নিয়েছেন? সে কি চায় আমাকে? যে উত্তর আমি পেয়েছিলুম তা হল, আপনি চাইলে ও এক কাপড়ে আজ রাতেই বেরিয়ে যাবে আপনার সঙ্গে। বিয়ের দিন রাত্তিরে যখন বুঝতে পারলুম ওদের ওই আকদের শর্ত কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে, তখন বাসরে আমি নার্গিসকে প্রস্তাব দিয়েছিলুম – মনে রেখো মুজফ্ফর ভাই, আকদে আমি সই করিনি, কিন্তু ইজাব কবুল তো হয়েছিল – আমি প্রস্তাব দিয়েছিলুম, আমার হাত ধর, আমরা বেরিয়ে যাই। গলাটা ধরে আসে কাজির। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ বসে থাকে সে। তারপর বলে, ও রাজি হয়নি।
সীমানা - ১৫ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৫ অক্টোবর ২০২২ | ২৫৭৩ বার পঠিত
কাজিকে এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খারাপ লাগে মুজফ্ফরের। একেই ওর শরীর ভালো নেই, তার ওপর আবার বকাবকি করল সে। সত্যিই তো, বেচারার স্বভাবই এরকম। কাজি বিশ্বাস করে না ভূ-ভারতে এমন কোন মানুষই নেই। কেউ যদি ঠকিয়েও নেয়, কাজি হজম করে নেবে বিনা বাক্যব্যয়ে। মুজফ্ফর বলে, তোমার শরীর ঠিক আছে, কাজি?
নবনীতার কয়েকদিন : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব | ২৫ অক্টোবর ২০২২ | ১৬৮১ বার পঠিত | মন্তব্য : ৬
বাবা হঠাৎ মারা গেলে কী হবে জানত না নবনীতা, কিন্তু মা-ও যে জানত না সেটা ও বুঝল পরে। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলত, কিন্তু চলত তো। মারা যাবার পর মা বলল, বাবার মরদেহ হাসপাতালে দান করা হবে, সেটাই বাবার ইচ্ছে ছিল। রাণীকুঠিতে কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার ভ্যাটের পিছনে প্রায়-পড়া-যায়-না এরকম দেওয়াল লিখন একটা মাঝে-মাঝেই দেখেছে নবনীতা, সেখানেই একটা ফোন নম্বর দেখেছিল ও, মরণোত্তর দেহদানের জন্যে। নম্বরটা দেখে এসে সেখানে ফোন করল নবনীতা, এক ভদ্রলোক এসে দেখে গেলেন, তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে একজন ডাক্তার আর দলবল নিয়ে এসে নিয়ে গেলেন দেহটা। ওর ভয় ছিল ওরা হয়তো পয়সা-কড়ি চাইবে কিছু; চাইল না কিন্তু, একটা ছাপা কাগজে শুধু সই করাল মাকে দিয়ে। নবনীতাকে ওরা বলেওছিল ওদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে, ও যেতে চায়নি। ওদের মুখ দেখে মনে হল একটু অবাক হয়েছে ওরা, কিন্তু বলল না কিছু। সেদিনই সন্ধ্যেবেলা ওদের একজন এসে হাসপাতালের সার্টিফিকেট একখানা দিয়ে গেল, বলল, এটা দিয়ে কর্পোরেশন থেকে ডেথ-সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। তা ছাড়াও ব্যাঙ্কে, অফিসে, নানা জায়গায় কাজে লাগবে এটা, কাগজটা যেন হারিয়ে না ফেলে ওরা।
সীমানা - ১৬ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৯ অক্টোবর ২০২২ | ২৮০৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আর আমি?– প্রশ্ন করে কাজি।
তুমি? তুমিই খানিকটা আমার প্রেরণা বলতে পার। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে যখন তুমি প্রথম কবিতা পাঠালে করাচি থেকে, আমি তখন সমিতির সহকারী সম্পাদক। তার আগে দুয়েকখানা চিঠিও তুমি লিখেছিলে। কিন্তু ক্ষমা নামে একটা কবিতা যখন পাঠালে, তা ছাপা হল। তোমার প্রথম ছাপা কবিতা। ছাপাবার সময় শুধু কবিতাটার নাম আমি বদলিয়ে দিয়েছিলাম, ক্ষমার বদলে মুক্তি। তুমি রাগ তো করলেই না, চিঠি লিখে ধন্যবাদ দিলে।
সীমানা - ১৭ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১২ নভেম্বর ২০২২ | ২৭১৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
পলিটিক্স্ তো এক-একজনের এক-এক রকমের হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি নিজেই ন্যাশনাল কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হয়েছেন। তার মানে তো এই নয় যে, সরকারী স্কুল-কলেজ যারা এখনও ছাড়তে রাজি নয় আপনি তাদের বিরোধী। মূল একটা ঐকমত্য থাকলেই সংবাদপত্রে এক সঙ্গে কাজ করা যায়, বলে মুজফ্ফর, সেখানেই আমাদের প্রগতিশীলতা। নানা মতকে একটা প্ল্যাটফর্মে এনে আলোচনায় কোন আপত্তি নেই আমাদের। নিজেদের একটা মত থাকতেই পারে, কিন্তু বিরুদ্ধ মতকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই মত কাগজে ছাপতে কোন আপত্তি হবে না আমাদের। তবে হ্যাঁ, কৃষক শ্রমিক অভুক্ত অর্ধভুক্তদের কথা আমরা লিখব, লিখব পূর্ণ স্বাধীনতার কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পাব না। সংবাদপত্র কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখপত্র এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না, কিন্তু তাঁবেদারও নয় কারো।
সীমানা - ১৮ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৬ নভেম্বর ২০২২ | ২৭৪৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
পবিত্র বোধ হয় আবার কিছু বলবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সুভাষ নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলল, নজরুল সাহেব, আজ সকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আপনি যখন কনফার্ম করলেন আপনিই নজরুল ইসলাম, আমি তখনই আপনাকে একটা প্রস্তাব দেব ভাবছিলাম। সেই জন্যেই আমি আপনার নবযুগের কথাটা তুলছিলাম। আপনারা তো এতক্ষণে শুনেইছেন, কয়েকমাস আগে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার বাসনায় আমি চিত্তরঞ্জন দাশ মশায়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি অতি স্নেহে আমাকে তাঁর সঙ্গী করতে রাজি হলেন। আমাকে তিনি প্রথম দিনেই দুটো কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন; এক, গৌড়ীয় বিদ্যায়তনের অধ্যক্ষতা, এবং দুই, বাংলায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচারের দায়িত্ব। ওই যে স্টেট্স্ম্যানের মন্তব্যের যে-কথা পবিত্রবাবু বলছিলেন সেটা ওই প্রচারেরই একটা অংশবিশেষ। কিন্তু আমার বাসনা আছে, বাংলার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটা বাংলা দৈনিকপত্র বের করার। আমি ভাবছিলাম, এ ব্যাপারে যদি আপনার সক্রিয় সাহায্য পাওয়া যায়।
সীমানা - ১৯ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৬০১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
কাগজখানা হাতে নিয়েই কাজি বলে, এ কী! প্রথমেই তো বানান ভুল।
কেন, কোন্ বানানটা?
এই যে, কাঠবেড়ালী।
ঠিকই তো আছে; ক-য় আ-কারে কা আর ঠ কাঠ, ব-য় এ-কারে বে র-য় আ-কারে রা আর ল-য় দীর্ঘ ঈ, লী। কাঠবেরালী।
আরে, এ তো বাঙালদের বানান হল, ভুল।
তুমি কি তাহলে ইংরাজি বানান চাও?
ইংরাজি নয়, ইংরিজি। কিন্তু সেটাই বা চাইব কেন? বিশুদ্ধ বাংলা বানান, কাঠবেড়ালী। ব-য়ে শূন্য র নয়, ড-য়ে শূন্য ড়-য়ে আ-কার, ড়া। বেড়ালী, কাঠবেড়ালী।
সীমানা - ২০ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৩৯০ বার পঠিত
জোর? জোর করার কথা আসে কোথা থেকে? – বলেন আবুবক্র্, মোগল সম্রাট আকবরের জন্মের কথা জানেন তো? তাঁর জন্মের সময় তাঁর পিতা যুদ্ধপর্যুদস্ত হুমায়ুন কিছু পারিষদ এবং গর্ভবতী যুবতী সম্রাজ্ঞীসহ অমরকোটের রাণার দুর্গে আশ্রিত। সেই অবস্থায় পুত্র জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবরের জন্ম হয়। পারিষদদের কাছে মহার্ঘ কিছু আছে কিনা খোঁজ করতে করতে জৌহর নামক একজন পণ্ডিত আমীরের কাছে দু'শো খোরাসানী স্বর্ণমুদ্রা, একটি রজতনির্মিত রিস্টলেট এবং এবং খানিকটা মৃগনাভি হুমায়ুন পেয়ে গেলেন। স্বর্ণমুদ্রা বা রজতনির্মিত অলঙ্কারটি হুমায়ুন গ্রহণ করলেন না। মৃগনাভিটুকু স্বহস্তে বহু ছোট ছোট টুকরো করে উপস্থিত সকলকে একটি করে টুকরো তিনি উপহার দিলেন। নিজের শরীরজাত যে মৃগনাভির সুগন্ধে মাতোয়ালা মৃগটি নিজেই উন্মাদগ্রস্ত হয়, সেই গন্ধে বহু যোজন আমোদিত হল। মঙ্গলাচরণ করে হুমায়ুন উপস্থিত সকলকে বললেন, আপনারা প্রার্থনা করুন, এই আশ্চর্য সুগন্ধের মতো আমার এই সদ্যোজাত পুত্র আকবারের সুকর্মের ফল এবং যশ যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সীমানা - ২১ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৩৬৮ বার পঠিত
গতকাল, কাজি বলে, ঘুম আসছিল না কাল রাতে; তারপর হঠাৎ কেমন মনে হল, একটা কবিতা লিখতে হবে। ওদিকে মুজফ্ফর তখন গভীর ঘুমে। আমি উঠে ভয়ে ভয়ে আলোটা জ্বালালুম, পাছে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দেখলুম ও ঘুমিয়েই চলেছে, আলো বুঝতেও পারছে না। তখন লিখতে শুরু করলুম, পেনসিল দিয়ে। কেমন যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল মনের মধ্যে বোঝাতে পারব না আপনাকে। মনে হচ্ছিল, দোয়াত-কলম দিয়ে পারব না লিখতে, কালি শুকিয়ে যাওয়া, দোয়াতে আবার কলম ডোবানো, এসব করতে পারব না, করার সময় হবে না। পেনসিল দিয়ে কিন্তু ঝর ঝর করে লেখাটা হয়ে গেল অবিনাশদা। লেখাটা দেখুন, বিশেষ কিছু কাটাকুটি নেই, যেন আমার মাথার মধ্যে ছিলই কবিতাটা। শুরু করতেই নিজেই নিজেকে যেন টেনে নিয়ে গেল। লেখা শেষ হতে, মুজফ্ফরকে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তুললুম। কাউকে একটা শোনাতেই হবে।
সীমানা - ২২ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৪০১ বার পঠিত
আগুন জ্বললো পরের দিন, সম্পূর্ণ নতুন আবহে। এমনটা কাজি দেখেনি আগে; দোলের আগের দিন, সন্ধ্যে পেরিয়ে তখন রাত অনেকটাই। পরের দিন পূর্ণিমা, আজই আকাশ ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। নানারকমের কাঠকুটো যোগাড় করে গ্রামের ছেলেরা এসে জমিদারবাবুর প্রাঙ্গনে আগুন জ্বালাল। ছেলের দল বলল নেড়াপোড়া, কিরণশঙ্কর বললেন চাঁচর। তারপর বললেন, ওদের নেড়াপোড়া কথাটাও কিন্তু বেশ যুক্তিযুক্ত। ধানকাটা হয়ে গেছে, পিঠেপায়েসের উৎসবও শেষ। এখন নতুন করে জমিতে কাজ শুরু হবে, তার আগে ক্ষেতে পড়ে-থাকা শস্যস্তম্ব, মানে, শস্য কেটে নেবার পর ক্ষেতে পড়ে থাকে যেটুকু, যাকে গ্রাম্য ভাষায় নেড়া বলে, তা পোড়ানো হবে।
সীমানা - ২৩ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২০২১ বার পঠিত
ভালো লাগে না কাজির, সে স্বভাবতই খোলামেলা চরিত্রের মানুষ, এই-যে দুলির সঙ্গে এমন একটা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল সে, সেটাকে যে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করতে হচ্ছে, এ তার ভালো লাগে না। কিন্তু গোপন না করেই বা কী উপায়? দুলি তো একেবারেই ছেলেমানুষ; নিজের ভালো যদি নিজে সে বুঝত! কাজির মতো একজন ছন্নছাড়া বিষয়আশয়হীন গৃহহীন অর্থসংস্থানহীন মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অর্থ যদি সে বুঝত! বোঝে না, তাই কাজির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। কিন্তু কাজির যে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে! ছন্নছাড়া হতে পারি, কিন্তু আমার মতো ভাগ্যবান কে আছে!
সীমানা - ২৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ মার্চ ২০২৩ | ১৯৮২ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
পত্রিকার নাম ধূমকেতু, তার সম্পাদককে বলা হল সারথি। উনিশশো বাইশের এগারই আগস্ট বেরল প্রথম সংখ্যা ধূমকেতু, রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী তার শিরোভূষণ। এর এক বছর আগে, উনিশশো একুশের সেপ্টেম্বরে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক বহুল প্রচারিত আলোচনায় রবীন্দ্রনাথকে অসহযোগ আন্দোলন, বিদেশী বস্ত্র বয়কট এবং চরকাস্ত্র প্রয়োগে স্বরাজের ভাবনায় নিজের মতে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন গান্ধী। এক বছর পর নজরুলের এই প্রয়াসকে প্রাণ-ভরে আশীর্বাদ জানালেন কবি!
সীমানা - ২৫ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ মার্চ ২০২৩ | ২১০৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
কাজিদা, গান্ধীজী আর গুরুদেবের জোড়াসাঁকোর বাড়ির আলোচনার কথা তুমি তো জানই, গান্ধী তখন তাঁর অসহযোগিতার উপযোগিতা রবীন্দ্রনাথকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অনেক কম বয়েসে জমিদারি চালাবার কাজ নিয়ে কবি যখন শিলাইদহে যান তখনই তিনি আমাদের দেশের গ্রামীণ দুর্দশার কারণ সম্যক বুঝেছিলেন। সেই কারণটাই তিনি বুঝিয়েছিলেন এল্ম্হার্স্ট সাহেবকে: এক, গ্রামের মানুষ এখন হারিয়েছে তার আত্মবিশ্বাস, সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে তার বর্তমান দুর্দশার পরিবর্তন সম্ভব; আর দুই, তাদের বর্তমান অবক্ষয় রুখে দিয়ে প্রগতির পথে তাদের ফিরিয়ে আনতে হলে ফাঁকা রাজনৈতিক শ্লোগানে কাজ হবে না; দুর্দশার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাহায্যে দুর্দশার মূল কারণ নির্ধারণ করে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রয়োগই এই দুর্দশা বদলাতে পারে।
সীমানা - ২৬ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ২০৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
জেল থেকে বেরিয়ে অবধি কাজির মনে পড়ছে দুলির কথা। সমস্তিপুর থেকে কুমিল্লায় ফিরেই গ্রেপ্তার হয়েছিল ও। সে সময় মাসিমাকে ও বলে এসেছিল, ছাড়া যখনই পাব, চলে আসব আমি, সে যতদিনেই হোক না কেন। কাগজ-পত্রে জানতে পারবেন সবই। দুলিকে বলবেন, ওর জন্যে আমি অপেক্ষা করে থাকব। দুলি অপেক্ষা করে আছে, ওকে যেতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সীমানা - ২৭ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৬ মে ২০২৩ | ১৮৪২ বার পঠিত
বৈশাখ মাসের ভারতীতে নজরুল ইসলাম লিখল বিদ্রোহী বাণী নামে এক কবিতা। লোকের মুখে মুখে এই কবিতা প্রচার হয়ে এমন আবেগের সৃষ্টি করল যে সত্যাগ্রহের উদ্বোধনের দিন মাঠে আর লোক ধরে না। আন্দোলনের উদ্বোধনের দিন সকাল থেকেই মন্দির-সংলগ্ন বিশাল মাঠে জনসমাগম। আর সেই সমাগমকে ঘিরে আছে সত্য ও তার দলবল। কর্তৃপক্ষের সঙ্কেত পেলেই শুরু হবে নিধনযজ্ঞ। নির্দিষ্ট সময়ে কাজির দিকে তাকিয়ে দেশবন্ধু বললেন, সত্যাগ্রহ শুরু হোক কাজির উদ্বোধন সঙ্গীত দিয়ে। দৃপ্ত কণ্ঠে কাজি গান ধরে।লাঠিয়ালরা প্রস্তুত। সঙ্কেতমাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে। মন্দিরের পাশেই এই গান! এ কি ভাবা যায়! এই মঞ্চেরই এক কোণে দাঁড়িয়ে সত্য নিজে, নীরব। অনেকগুলো চোখ তার দিকে। গান শেষ হলে সে বলে, কাজি, আর একবার গাও।
সীমানা - ২৮ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২০ মে ২০২৩ | ১৭৫৪ বার পঠিত
খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর হিন্দু-মুসলমানের উদ্বায়ী প্রীতিভাব এখন ক্রমহ্রাসমান, মালাবারে নায়ার জমিদার হত্যা এবং ধর্মান্তরকরণের খবর আসছে, এই সময় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের সংক্রমণ রোধ করাই সবচেয়ে জরুরী। ডাক পড়েছে বাঁকুড়ায়। সেখানে ক্রীশ্চান কলেজের খদ্দরপরিহিত অধ্যক্ষ সস্ত্রীক ব্রাউন সাহেব বিপুল-সংখ্যক ছাত্রদের সঙ্গে রেলস্টেশনে এসে অভ্যর্থনা জানালেন কাজিকে। ছাত্রদের অভ্যর্থনাজনিত চন্দনচর্চিত নজরুল কামালপাশা আবৃত্তি করে হৃদয় জয় করল তাদের। তারপর গঙ্গাজলঘাঁটি। এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ের অমর নামের এক স্বেচ্ছাসেবকের স্মৃতিতে অমর-কানন নামে এক আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, নজরুল উদ্বোধন করল সেই আশ্রমের।
সীমানা - ২৯ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ জুন ২০২৩ | ১৬৩৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
কলকাতায় রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে কোন ধর্মীয় মিছিলকে উপলক্ষ করে শুরু হয়ে গেল হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতার সঙ্গে কাজির নিত্য-যোগাযোগ, দাঙ্গার খবরে বিপর্যস্ত সে। এবারের সম্মেলন উপলক্ষে সে যে উদ্বোধন সঙ্গীত রচনা করল – পরে সেই সঙ্গীত বিশ্বখ্যাত হয়েছে, সুভাষচন্দ্র সদর্পে বলেছেন, আমরা জেলেই থাকি বা জেলের বাইরে, এই গান আমাদের সব সময় উদ্দীপিত করবে, সব সময় এই গান আমরা গাইব। লিখেই তার বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে, একটা গান লিখেছি, স্বরলিপি পাঠাচ্ছি তোমায়। এখনকার এই দাঙ্গার সময়ে, এই গান আমরা দুজনে একসঙ্গে গাইব এবারের প্রদেশ কংগ্রেসের উদ্বোধনে:
দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার।
সীমানা - ৩০ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ জুন ২০২৩ | ১৫৪২ বার পঠিত
নাসির সাহেবের ভাষায়, “ধর্মের নামে যে সমস্ত ভণ্ড সমাজহিতৈষী কথায় কথায় বিরুদ্ধবাদীদের কাফের ও ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়ে সমাজের অশিক্ষিত জনসাধারণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে, নানা তহবিলের সৃষ্টি করে যে সমস্ত প্রবঞ্চকের দল সে সব তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করে সম্পত্তি ক্রয় করছে, ঐ সব ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মূলোৎপাটনই সওগাতের উদ্দেশ্য।”
সীমানা - ৩১ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০১ জুলাই ২০২৩ | ১৩৫০ বার পঠিত
প্রায়-তিরিশের কাজি যেন সদ্য-প্রেমোন্মত্ত কিশোর। পরের দিন সকালেই কৃষ্ণনগর, আর সেই বিকেলেই আবার চিঠি লিখতে বসে কাজি। এবার আর কোন কাব্যিক ব্যঞ্জনা ছল-চাতুরী নয়; স্পষ্ট ঘোষণা, সে ডুবেছে। প্রেমোন্মাদের চিরকেলে বিলাপের মতোই এই তিরিশ-ছুঁই-ছুঁই নব কিশোর যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে প্রিয়াকে লিখতে পারে না সোজাসুজি; মোতাহারকে লেখে, এ চিঠি শুধু তোমার এবং আর একজনের। একে secret মনে করো। আর একজনকে দিও এই চিঠিটা দুদিনের জন্য। ভাবা যায়!
সীমানা - ৩২ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৬ জুলাই ২০২৩ | ১২৬৩ বার পঠিত
শিয়ারশোলের ইশকুলে যখন ভর্তি হলুম, কাজি বলতে থাকে, তখন আমার কবিতা নজরে পড়ল হেড স্যর নগেন্দ্রবাবুর। তিনি মাঝে-মাঝেই আমার কবিতার খাতা দেখতে চাইতেন; দেখে, ছন্দ-টন্দ নিয়ে খানিকটা আলোচনাও করতেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা শব্দ এক-আধটা লাইন বদলিয়ে দেবার উপদেশও দিতেন স্যর। তিনিই স্কুলের আর একজন মাষ্টারমশাই, সতীশবাবু স্যর, সতীশ কাঞ্জিলাল – শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করতেন তিনি নিয়মিত – তাঁর কাছে আমার কথা বলেছিলেন। কাঞ্জিলাল স্যর আমাকে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেছেন অনেকবার। তাঁর কাছে সঙ্গীতের গোড়ার কথা কিছু কিছু শিখেছি।
সীমানা - ৩৩ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৫ আগস্ট ২০২৩ | ১২৪৭ বার পঠিত
এবার হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। বললেন, আমার বক্তৃতার ফাঁকটা ভরাট করে দিল আপনার পুত্র। আমি বলেছিলাম আপনি বাংলার কবি বাঙালির কবি। যে-কথাটা বলতে ভুলেছিলাম, তা হল আপনি এখন থেকে বয়েস-সম্পর্ক নির্বিশেষে বাঙালির শুধু কবি ন'ন, কাজিদাও! এবার বুলবুলের দিকে তাকিয়ে বলেন, গুড বয়, বুদ্ধিমান ছেলে। তোমাকে কেমিস্ট্রি পড়াতেই হবে।
সীমানা - ৩৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৯ আগস্ট ২০২৩ | ১১৪৫ বার পঠিত
সুভাষবাবু তো স্পষ্টই বললেন, “নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় – এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের 'দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরু'র মত প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” কাজিদা নিজেও তো সম্বর্ধনার উত্তরে বলেছিল,
“...আমি জানি, আমাকে পরিপূর্ণরূপে আজও দিতে পারিনি; আমার দেবার ক্ষুধা আজও মেটেনি। যে উচ্চ গিরিশিখরের পলাতক সাগরসন্ধানী জলস্রোত আমি, সেই গিরিশিখরের মহিমাকে যেন খর্ব না করি, যেন মরুপথে পথ না হারাই!– এই আশীর্বাদ আপনারা করুন।”
সীমানা - ৩৫ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১২৪৪ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
দারিদ্রের অনেকগুলো অবস্থা পেরিয়ে আজ যেখানে পৌঁচেছে কাজি, কোন হঠকারিতায় সেখান থেকে আগের অবস্থায় সে ফিরে যেতে চায় না। বুলবুল আর ইহজগতে নেই, কিন্তু এখন আছে সানি, কাজি সব্যসাচি বা কাজি সানিয়াৎসেন যার অপর নাম। এক বছর পাঁচ মাস তার বয়েস। তাকে তো বড় করে তুলতেই হবে। তার জীবনে যেন স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব না হয়। কাজি তাই তার এখনকার রুটিন বদলাতে চায় না। রোজ সকালে প্রতিদিনের মতো সে পৌঁছিয়ে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে।
সীমানা - ৩৬ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১৭৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
প্রকাশন জগতের মানুষ, নজরুল বিস্ময় দেখায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী জাহানারাকে চোখে দেখেননি! বলেন কী! গল্প লেখেন, সেই গল্প ছাপানোর জন্যে কোন পত্রিকার সম্পাদককে ধরাধরি করেন না, নিজেরই পত্রিকা আছে। অসাধারণ সুন্দরী সে তো বললুমই, ধনীর দুলালী; মালদা থেকে বাংলার সমস্ত উত্তর দিক হয়ে পশ্চিমে বিহারের মিথিলা পর্যন্ত যে ভূমি, তার প্রধানতম জমিদার বংশ – জমিদার না বলে রাজবংশই বলা উচিত – তার সন্তান। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের কল্লোলের লেখকগোষ্ঠীর অনেক লেখকের সঙ্গেই এঁর যোগাযোগ। সাধারণত থাকেন কলকাতায়। আপনার মতো আমিও চিনতুম না গত বছর পর্যন্ত।
সীমানা - ৩৭ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৯২৪ বার পঠিত
সব ধর্মেরই ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজির অপছন্দ, সমাজের নানা রকমের মনুষ্যকৃত ভেদাভেদের সে বিরোধী, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অক্ষম বা দুর্বলের উপর দমননীতির বিবর্তিত কায়দা-কানুনগুলো ধ্বংসের জন্যে লড়াই করতে সে সদাপ্রস্তুত; মানুষের প্রতি ভালোবাসা তার সীমাহীন, এবং তাই সে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সৈনিক হয়েছে, অথচ নির্দিষ্ট কোন আদর্শের পথে অবিচলিত পথিক কোনদিনই হতে পারেনি। গান্ধীর মতাদর্শ অনুসরণ করে সে লড়াই করেছে যেমন, বাঘা যতীনের পথ বা বলশেভিকদের পথও তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সাম্যের গান গাইতে গাইতে যখন সে শ্রমিক-কৃষকের লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে, শ্রমিক-শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বাংলা-অনুবাদ করছে, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেস-প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও তার অসুবিধে হয়নি।
সীমানা - ৩৮ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১০১০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
দুশো? ঠিক আছে, বললেন গুরুদেব। আমি কিন্তু তোকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে বলছি না। শান্তিনিকেতনে তুই কারো দয়ায় থাকিস না, এখানে থাকার অধিকার তোর স্বোপার্জিত। আমি শুধু তোকে নিজের চোখে, অন্যের প্রভাব ছাড়া, সম্পূর্ণ নিজের দৃষ্টিতে জায়গাটা দেখতে পাঠাচ্ছি। যতদিন ভালো লাগে, থাকবি। ফিরে আসতে ইচ্ছে না করে যদি, আসবি না। যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে, কারোকে জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। এখানে তোর নির্দিষ্ট কাজ তো আছেই।
আবোল তাবোল : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | নাটক | ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ৬৮১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
আমড়াগাছের নীচে একটি সভা বসেছে। এখন মাঝ রাত্তির। সভায় উপস্থিত বকচ্ছপ, বিছাগল, হাঁসজারু, গিরগিটিয়া, হাতিমি, মোরগরু, সিংহরিণ। একটু উঁচু জায়গায় বসে আছে প্যাঁচানি, সে এই সভার সভাপতি। সকলেরই চোখে জল, সমবেত চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমন সময় হাত তুলে প্যাঁচানি উপস্থিত সবাইকে শান্ত হবার ইঙ্গিত দেয়, এক মুহূর্তে কান্নার শব্দ থেমে যায়, প্যাঁচানি হুট হুট শব্দে সকলের আচরণ অনুমোদন করে। এমন সময় ঘুম-ভেঙে-উঠে-আসা হরু চোখ কচলাতে কচলাতে প্রবেশ করে।
সীমানা - ৩৯ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১০০৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ১
পাতালপুরী আর রানিগঞ্জ শব্দদুটো কাছাকাছি দেখে আন্দাজ করতে পারছিস সিনেমার গল্পটা কী বিষয়ে? কয়লাখনি। সেই কতদিন আগে হক সাহেবের নবযুগ পত্রিকায় – আরে, হক সাহেব বলছি কেন? তুই তো নিজেই ওই পত্রিকার সোল সেলিং এজেন্ট ছিলি, মনে নেই? – কয়লাখনির শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলুম একটা। এখন আবার এসেছি ওদের সঙ্গে মিশতে; সারা দিনের ডিউটির পর ওদের বস্তিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কী ধরণের অবসর ওরা কাটায় তাই বুঝতে। এই সব বুঝে তারপর গান লিখব, সুর দেব তাতে। আরও কয়েকটা কাজ করব, শৈলজাকে বলা আছে।
সীমানা - ৪০ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪৩০ বার পঠিত
কাজিদার আহ্বান তো আর ব্যর্থ হবে না, কয়েকদিন পরেই চিঠি লিখে কলকাতায় হাজির হয় পিংলা। স্বদেশীয়ানা, দেশপ্রেম – এইসব উত্তেজনাকর শব্দগুলোর কী আবেদন কাজিদার কাছে, তা পিংলার চেয়ে বেশি কে-ই বা জানে! কিন্তু যে উত্তেজনায় শুরু, কিছুদিন বা কয়েকবছর সেই উত্তেজনার বেগেই এগিয়ে চলা আর তারপর হঠাৎই একদিন উত্তেজনাতেই শেষ! কাজিদা যখন বহরমপুরের জেল-এ, তখন তাকে একটা চিঠি লিখেছিল পিংলা – তার স্পষ্ট মনে আছে সে চিঠির কথা – তাতে সে অভিযোগ করে বলেছিল স্পষ্ট কোন রাজনৈতিক আদর্শ কাজিদার জন্যে নয়, সে কখনও বিপ্লববাদী কখনও গান্ধীবাদী; মুজফ্ফর আহ্মদ সঙ্গে থাকলে সে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করে, জেলে-চাষা-শ্রমিক-কৃষকের জয়ধ্বনি তখন তার কথাবার্তায়, মিটিং-মিছিলে আর গানে-কবিতায়।
সীমানা - ৪৪ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩৬১ বার পঠিত
হ্যাঁ শোন, বলে সে, যাবার আগে তোমাকে আর একটা অনুরোধ করব। এই অনুরোধটা সুধাকান্তদাদার পক্ষ থেকে। সুধাকান্তদাদা বলেছেন, গত-বছর সতেরই ফেব্রুয়ারিতে তুমি নাকি রেডিওতে বাংলা ছন্দ নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করেছিলে। রেডিওর ভাষায়, কথিকা। ওঁর ভাষাতেই বলি, উনি বলেছেন, অনবদ্য। বলেছেন, এই কথিকা শুনে উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তুমি কীভাবে সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছ, কবিতা তোমাকে ছেড়ে গেছে! সুধাকান্তদাদা আমাকে বিশেষ করে তোমাকে বলতে বলে দিয়েছেন যে, তুমি যে শুধু কবিতা লেখা চালিয়েই যাবে তা-ই নয়, রেডিওতে তুমি কবিতা রচনার একটা শিক্ষাবাসরও চালু করতে পার। তুমি ইচ্ছে প্রকাশ করলে রেডিওর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই রাজি হবে। শুধু যে নতুন কবির দল আর কবিতা লেখায় উৎসাহীরাই এতে উপকৃত হবে তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠিত অনেক কবিরও তুমি তাতে কৃতজ্ঞতাভাজন হবে।
সীমানা - ৪৫ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ২১৮ বার পঠিত
নজরুল এবারেও কোন জবাব দেয়নি। সামনে একটা দড়ি-বাঁধা ফাইল, সে খোলে সেটা। একেবারে ওপরের কাগজখানা হাতে তুলে নেয়, যা লেখা আছে কাগজে তাতে চোখ বোলায় একটু, আবার রেখে দেয় ফাইলে। ঘরে আরেকবার ঢোকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ; এবার একটু দ্রুততর, বলে, মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারছে না পুলিশ, ধাক্কাধাক্কি হাতাহাতি চলছে। এবার ধারাবিবরণী একটু বন্ধ করে তোমার কবিতাটা পড়া দরকার। কোনরকমে এই কথাগুলো বলে নিজের একটা হাত সে বাড়িয়ে দেয় নজরুলের দিকে। নজরুল নৃপেনের হাতটা ধরে, ফাইলটাও সঙ্গে নেয়। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে স্টুডিওর ভেতরে যায় ওরা, পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে। যে দু'জন মাইকের সামনে বসেছিল, দুজনেরই কানে একটা করে ইয়ারফোন। শবযাত্রার সঙ্গে অতি ধীরগতিতে রেডিওর গাড়ি চলতে চলতে শবযাত্রার যে সংক্ষিপ্ত ধারাবিবরণী সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে রেডিওর স্টুডিওয়, ইয়ারফোনে তা শুনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রচারযোগ্য ভাষায় তার তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে দুজন ঘোষকের একজন বেতারে তা পাঠিয়ে দিচ্ছে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বরে। দ্বিতীয় জন, এখন যে শুধু ইয়ারফোনেই মনোযোগী, চেয়ারে বসে-থাকা নজরুল-নৃপেনের দিকে সে হাত তুলে ইঙ্গিত করতেই নৃপেন কাজির হাতে হাত রাখে। কাজি একটুও সময় নষ্ট না করে পড়তে শুরু করে:
সীমানা - ৪৬ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ০৪ মে ২০২৪ | ২৪০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্ল্ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে।
সীমানা - ৪৭ : শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : উপন্যাস | ১৮ মে ২০২৪ | ৩৫ বার পঠিত
গিরিবালা দেবী আর প্রমীলা দুজনেই বললেন, নজরুলের সঙ্গে অরবিন্দর সূক্ষ্মদেহে দেখা হবার কথা নজরুল আগেও অনেকবার বলেছে। শুধু তাঁদেরই নয়, বলেছে আরও অনেককেই। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। তাতে কিছুই আসে-যায়নি নজরুলের, তবে এবারের মতো এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি আগে। এবার এতটাই অসুস্থ নজরুল যে অফিসে যেতে পারল না বেশ কয়েকদিন। এদিকে কলকাতার য়্যুনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক নির্বাচিত করে তার কাছে একরাশ উত্তরপত্র আর পরীক্ষকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে য়্যুনিভার্সিটি। নবযুগে নজরুলের সহকারী কালীপদ গুহ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ করেছে আগে। সে-ই উত্তরপত্র পরীক্ষায় নজরুলকে সাহায্য করতে শুরু করল। ফজলুল হক সাহেব নজরুলকে জানিয়েছেন, শরীর যতদিন সম্পূর্ণ ভালো না হয় ততদিন তার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। অমলেন্দু বা কালীপদদের ডাকিয়ে এনে বাড়িতে বসেই পত্রিকা সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যেতে পারে সে। এই সুযোগে কালীপদ থাকতেই শুরু করল নজরুলের বাড়িতে, এখন নজরুলের যে অবস্থা তাতে ঘড়ি-ধরে কাজ করা তো সম্ভব নয় তার পক্ষে। চব্বিশ-ঘন্টায় যখনই কাজের মূড আসবে তখনই কাজ! সেই সময় কালীপদ সঙ্গে না-থাকলে কি চলবে?